Islamic News BD - The Lesson of Peace
মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি
সোমবার, ০৫ জুন ২০২৩ ০১:৪৪ পূর্বাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদ সা:-কে জন্মগতভাবেই শিক্ষকসুলভ আচরণ দান করেছিলেন। তাঁর অনুপম শিক্ষানীতি ও পদ্ধতিতে মুগ্ধ ছিলেন সাহাবিরা। হজরত মুয়াবিয়া রা: বলেন, ‘তাঁর জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তাঁর আগে ও পরে তাঁর চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি।
তাই আমাদেরও শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নিচে রাসূল সা:-এর অনুসৃত কয়েকটি শিক্ষাপদ্ধতি তুলে ধরা হলো।

পিতৃস্নেহে শিক্ষাদান : রাসূলের শিক্ষকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি ছাত্রদের প্রতি ছিলেন পিতার মতো স্নেহশীল। এ জন্যই তিনি ইরশাদ করেন, আমি হচ্ছি তোমাদের জন্য পিতার মতো। তাই আমি তোমাদের শিক্ষা দিই।
ছাত্রের মেধার দিকে খেয়াল : তিনি শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের মেধা ও বুদ্ধির প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন এবং সে অনুযায়ী তিনি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতেন। তিনি ছোট-বড় সবার মন-মেজাজের প্রতি সদা সতর্ক থাকতেন। প্রত্যেক মানুষকে তার আক্বল ও বিবেকানুযায়ী সম্বোধন করতেন।

মেধাশক্তি বিকাশের প্রতি যত্নশীল : তিনি ছাত্রদের মধ্যে জানার কৌতূহল জাগাতে তাদের সামনে নানা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতেন এবং তাদের কাছ থেকে উত্তর জানতে চাইতেন। যেন তারা প্রশ্ন করতে এবং তার উত্তর খুঁজতে অভ্যস্ত হয়। কেননা নিত্যনতুন প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে নিত্যনতুন জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহী করে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সা: সবার সামনে প্রশ্ন করলেন, একটা গাছ আছে, যার বরকত মুসলমানের মতো। যে গাছের পাতা কখনো শুকায় না এবং ঝরেও পড়ে না। সর্বদা ফল দেয়। তোমরা বলো তো ওই গাছ কোনটি? তখন প্রত্যেকে বিভিন্ন উত্তর দেয়া শুরু করল। ইবনে ওমর বলেন, আমার মনে হচ্ছিল ওই গাছ হচ্ছে খেজুর গাছ। তাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে অনেক বয়স্ক লোকও ছিল। আর আমি ছিলাম বাচ্চা। সর্বশেষ ইবনে ওমরের ধারণাই সঠিক হলো। কেউ বলতে না পারায় রাসূল সা: নিজেই বলে দিলেন সেটা হচ্ছে খেজুর গাছ।

প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতিতে শিক্ষাদান : শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের আলোচনা শুনে শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। এসব প্রশ্নের সমাধান না পেলে অনেক সময় পুরো বিষয়টিই শিক্ষার্থীর নিকট অস্পষ্ট থেকে যায়। সে পাঠের পাঠোদ্ধার করতে পারে না। আর প্রশ্নের উত্তর দিলে বিষয়টি যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জনে আরো আগ্রহী হয়। রাসূল সা: শিক্ষাদানের সময় শিক্ষার্থীর প্রশ্ন গ্রহণ করতেন এবং প্রশ্ন করার জন্য কখনো কখনো প্রশ্নকারীর প্রশংসাও করতেন। হজরত আবু আইয়ুব আনসারি রা: থেকে বর্ণিত।
‘এক ব্যক্তি রাসূল সা:-কে প্রশ্ন করে, আমাকে বলুন! কোন জিনিস আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দেবে এবং কোন জিনিস জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। নবী করিম সা: থামলেন এবং সাহাবাদের দিকে তাকালেন। অতঃপর বললেন, তাকে তওফিক দেয়া হয়েছে বা তাকে হেদায়েত দেয়া হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো- রাসূল সা: প্রশ্নটি শুনেই সাথে সাথে উত্তর দেননি। বরং তিনি চুপ থাকেন এবং সাহাবিদের দিকে তাকিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং প্রশ্নকারীর প্রশংসা করেন। যাতে প্রশ্নটির ব্যাপারে সবার মনোযোগ সৃষ্টি হয় এবং সবাই উপকৃত হতে পারে।

কিছু প্রশ্নের জবাব শিক্ষার্জনকারীদের ওপর ছেড়ে দেয়া : তিনি নিজে সব ক’টি প্রশ্নের উত্তর দিতেন না। কোনো কোনোটির উত্তর দেয়ার দায়িত্ব ছাত্রদের ওপর ছেড়ে দিতেন। যাতে তাদের দিয়ে বিষয়টির অনুশীলন করানো যায়। যেমন এক সাহাবি এসে নবী করিম সা:-এর নিকট স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। সেখানে হজরত আবু বকর রা: উপস্থিত ছিলেন। হজরত আবু বকর রা: উত্তর দেয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। রাসূল সা: তাকে অনুমতি দিলেন। ব্যাখ্যা দেয়ার পর আবু বকর রা: রাসূল সা:-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাখ্যা ঠিক হয়েছে? রাসূল সা: বলেন, ‘কিছু ঠিক হয়েছে আর কিছু ভুল।’
সফলদের প্রশংসা করা : তিনি সঠিক উত্তরদাতার সম্মাননাস্বরূপ প্রশংসা করতেন, বুকে হাত মেরে ‘শাবাশ!’ বলতেন। যেমন : হজরত উবাই ইবনে কা’বকে রাসূল সা: জিজ্ঞেস করেন, আল কুরআনে কোন আয়াতটি সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ? প্রথমে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সা: পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন ‘আয়াতুল কুরসি’। তখন রাসূল সা: তার বুকে হাত রেখে বলেন, ‘শাবাশ!’। আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য ইলম অর্জন সহজ করুন।

মৃদু শাসন করা : তিনি যেমন স্নেহশীল ও দয়ালু ছিলেন তেমনি তিনি প্রয়োজনে মৃদু শাসনও করতেন। যেমন : একবার তিনি বের হয়ে দেখেন সাহাবারা তাকদির নিয়ে তর্ক করছেন। তখন তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে বলেন, তোমাদের এ জন্য দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে? মূলত একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব হলো- ছাত্রদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসার পাশাপাশি তাদের আদব শিখানোর জন্য কখনো কখনো রাগ করা। তবে অবশ্যই ছাত্রদের অবস্থানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। আলোচ্য হাদিসে সাহাবিদের প্রতি রাসূল সা: মৃদু শাসন করেছেন। ছোট বাচ্চাদের শাসনের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
উপযুক্ত পরিবেশ নির্বাচন : শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। কোলাহলপূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিবেশ শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষক উভয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। রাসূল সা: শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করতেন। অর্থাৎ শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে স্থির হওয়ার এবং মনোসংযোগ স্থাপনের সুযোগ দিতেন। অতঃপর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে শিক্ষাদান শুরু করতেন। জারির ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত : ‘নিশ্চয় বিদায় হজের সময় রাসূল সা: তাকে বলেন, মানুষকে চুপ করতে বলো। অতঃপর তিনি বলেন, আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেয়ো না।’
ধীরস্থিরতার সাথে পাঠদান করা : রাসূলুল্লাহ সা: পাঠদানের সময় থেমে থেমে কথা বলতেন। যেন তা গ্রহণ করা শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। আবার এত ধীরেও বলতেন না যাতে কথার ছন্দ হারিয়ে যায়। বরং তিনি মধ্যম গতিতে থেমে থেমে পাঠ দান করতেন। হজরত আবু বাকরাহ রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা কী জানো- আজ কোন দিন? এটি কোন মাস? এটি কি জিলহজ নয়? এটি কোন শহর?’ প্রতিটি প্রশ্নের পর রাসূল সা: চুপ থাকেন এবং সাহাবারা উত্তর দেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন।

দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান : তিনি কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে, তাঁর দেহাবয়বেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হতো। তিনি দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান করতেন। অর্থাৎ বডি লেঙ্গুয়েজ ঠিক রেখে কথা বলতেন। কারণ, এতে বিষয়ের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রোতা শিক্ষার্থীরা সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হয় এবং বিষয়টি তার অন্তরে গেঁথে যায়। যেমন, তিনি যখন জান্নাতের কথা বলতেন, তখন তাঁর দেহ মুবারকে আনন্দের স্ফুরণ দেখা যেত। জাহান্নামের কথা বললে ভয়ে চেহারা মুবারকের রঙ বদলে যেত। যখন কোনো অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে বলতেন, তাঁর চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পেত এবং কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেত।
হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সা: যখন বক্তব্য দিতেন, তাঁর চোখ মুবারক লাল হয়ে যেত, আওয়াজ উঁচু হতো এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেত। যেন তিনি শত্রুসেনা সম্পর্কে সতর্ককারী।’