Islamic News BD - The Lesson of Peace
ইসলামী জীবনব্যবস্থায় দুনিয়া ও আখিরাতের পথ এক অভিন্ন
বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩ ২৩:৩৯ অপরাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,যদি কিয়ামত এসে যায় আর তোমাদের কারো হাতে খেজুরগাছের চারা থাকে, তবে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে তা রোপণ করা সম্ভব হলে সে যেন তা করে। কেননা এর বিনিময়ে সে প্রতিদান লাভ করবে। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯)

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর অন্তর্নিহিত বক্তব্যও অত্যন্ত গভীর। বাহ্যত নবীজি (সা.)-এর বক্তব্য ভিন্ন রকম হওয়ারই কথা ছিল। কেননা তিনি পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তিনি পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন এবং পরকালীন জীবন গঠনের আহ্বান জানাবেন। তিনি আহ্বান জানাবেন মানুষ যেন কিয়ামতের ভয়াবহ দিনের প্রস্তুতিস্বরূপ অন্তর পবিত্র করে এবং নিজের কর্মপন্থা শুধরে নেয়। বিশেষত যখন কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হবে, তখন দ্রুত আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং বিনীত হয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে, যেন ঈমানের সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। তিনি বলবেন, তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে নাও, পার্থিব কাজকর্ম ছেড়ে আল্লাহমুখী হও, সব সম্পর্ক পেছনে ছেড়ে আল্লাহর স্মরণে মগ্ন হও। যেন আল্লাহর স্মরণ অন্তরে নিয়ে তোমার মৃত্যু হয়। আর এমনটি বলাই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি তা বললেন না। তিনি যা বললেন, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। তিনি বললেন, যদি তোমাদের কারো হাতে খেজুরগাছের চারা থাকে এবং তা কিয়ামতের আগে রোপণ করা সম্ভব হয়, তবে সে যেন রোপণ করে। এতে সে সওয়াব বা প্রতিদান পাবে। কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন খেজুরগাছ লাগাতে। যে গাছে কয়েক বছর পর ফল আসে। অন্যদিকে কিয়ামত কয়েক মুহূর্তে সংঘটিত হবে। সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন নির্দেশ শুধু একজন আল্লাহর নবীই দিতে পারেন, সর্বশেষ নবীর পক্ষেই এমন নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব।

এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটিই প্রমাণ করে ইসলাম জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম। ইসলামী জীবনব্যবস্থায় দুনিয়া ও আখিরাতের রাস্তা পৃথক নয়; বরং তা একই রাস্তার দুটি পার্শ্ব। ইসলামী জীবন দর্শনে পরকালের পথ ভিন্ন নয়, যার নাম হবে ইবাদত এবং দুনিয়ার পথ ভিন্ন নয়, যার নাম হবে কাজ-কর্ম ও পরিশ্রম। দুনিয়া ও আখিরাতের রাস্তা একটিই, যেখানে কাজ-কর্ম ইবাদত থেকে পৃথক নয় এবং ইবাদতও কাজ-কর্ম থেকে ভিন্ন নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে উভয়টি একই জিনিস। তারা পাশাপাশি পথ চলে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামের একই নীতি। এক মুহূর্তে কিয়ামত চলে আসবে তার পরও চারা রোপণ করতে হবে, এটাই কাজের মূল্য। কত স্পষ্ট ও আলোকদীপ্ত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু কাজের মূল্য নয়, কাজের মাধ্যমেই যে পরকালের রাস্তা খুঁজে নিতে হবে এবং এটা ছাড়া আর কোনো পথ নেই সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত অধিকাংশ সময় মানবজাতি দুনিয়া ও আখিরাতকে পৃথক পৃথক রাস্তা মনে করেছে। পরকালের কাজগুলোকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করা হয়। ফলে দুনিয়ার কাজগুলো পরকালীন কাজের সময় নিঃশেষ করে ফেলে। দুনিয়া ও আখিরাতের পথ ভিন্ন এই চিন্তা মানুষের অন্তরের গভীরে প্রোথিত। মানবজীবনে তার প্রভাব বহুমুখী। এই পার্থক্যচিন্তার ওপর ভিত্তি করে যখন জীবন পরিচালিত হবে, তখন মানুষের জীবন দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠবে। সে জীবনে শান্তি ও স্বস্তি কখনোই আসবে না।

যখন মানুষ পার্থিব ও পরকালীন জীবনের পথ ভিন্ন বলে বিশ্বাস করবে, তখন তার সামনের জীবনে দুটি পৃথক লক্ষ্য থাকবে। এই বিপরীতমুখী লক্ষ্য ও প্রচেষ্টা মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে এবং তার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়। ফলে একদল লোক দুনিয়া ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করে। অপর একদল মানুষ পার্থিব জীবনকে লক্ষ্যে পরিণত করে এবং নানা উপায়ে সম্পদ লুটপাট ও আত্মসাৎ করতে থাকে। সে প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয় এবং তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে দুনিয়া ও আখিরাতের পথ পৃথক করে ফেলার পরিণতি দিন দিন তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। এর ফলে যে শুধু মানুষের পরকালীন জীবন ধ্বংস হচ্ছে তা নয়; বরং মানুষের বিভিন্ন প্রকার মানসিক সংকটও তৈরি হচ্ছে। মানুষের ভেতর মানসিক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বিকলাঙ্গ হওয়া, মানসিক ভারসাম্য হারানো ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। নতুন সভ্যতা মানবজাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। আর তা করেছে দুনিয়া ও আখিরাতের পথে প্রাচীর তুলে দিয়ে।

আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে অভিন্ন প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করেছেন। যার মধ্যে শরীর, বিবেক ও আত্মা, বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান, আত্মা ও বিবেক-বুদ্ধির পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সব কিছু অন্তর্ভুক্ত। কোনো সন্দেহ নেই, এগুলোর একটি অপরটির বিপরীত পথে চলতে চায়। নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রত্যেকেই নিজের মর্জিমতো চলতে থাকবে। কিন্তু আল্লাহ মানবপ্রকৃতিতে এগুলোর ভেতর ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উপাদানও রেখেছেন। আর তার মধ্যেই আছে মানুষের সাফল্যের রহস্য। মানুষের ভেতর বিদ্যমান বিপরীতমুখী উপাদানগুলো নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো দুনিয়া ও আখিরাতের পথ এক করে নেওয়া। কেননা দুনিয়া ও আখিরাতের পথ অভিন্ন হলে ব্যক্তির জীবিকা উপার্জন ও ইবাদত, শরীর ও আত্মা, কাজ ও চিন্তা, বাস্তবতা ও উপমার পথ ভিন্ন হওয়ার সংকট থাকবে না। জীবনের পৃথক পৃথক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের দ্বন্দ্বও শেষ হয়ে যাবে। মানুষের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি আসবে।

ইসলাম অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত উপায়ে মানবপ্রকৃতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের নিরসন করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কোরো এবং দুনিয়ায় নির্ধারিত তোমার অংশের কথা ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কোরো, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না। (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, বোলো, আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বোলো, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিন এসব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩২)