Islamic News BD - The Lesson of Peace
ভ্রাতৃত্ব্যপূর্ণ ব্যবহার এবং আত্মীয়তার অধিকারে ইসলাম সচেষ্ট
মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩ ০০:২৯ পূর্বাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। যা বনী আদমের একে অপরের মাঝে প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসার সু-নিপুণ সৌধ নির্মাণ করে। ভ্রাতৃত্ব্যপূর্ণ ব্যবহার সকলের কাম্য এবং ইসলামের দাবীও বটে। বিশেষ করে নিজ আত্মীয় স্ব-জনের সাথে সু-সম্পর্কের মজবুত আস্হা স্থাপন করা শুধু ইসলামী শরীয়তের বর্ণ বিন্যাসে নয়; মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিরও চাহিদা। কেননা, বাংলায় আত্মা থেকে আত্মীয়তা শব্দের উৎপত্তি। তাই আত্মার সাথে আত্মীয়তার নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া রক্তের ধারা থেকে আত্মীয়তার জন্ম। একটি সুন্দর সমাজ বা পরিবার গঠনে আত্মীয়তার সম্পর্ক অতুলনীয়। আত্মীয়তার সু-সম্পর্কের অটুট বন্ধন একজন ব্যক্তিকে সুখ-দুঃখ, অনুকূল-প্রতিকূল নানা ধরনের পরিস্থিতির মুকাবেলায় স্বাচ্ছন্দময় জীবন-যাপনে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে আত্মীয়তা বন্ধনের স্বর্ণ-সূতা পুড়িয়ে ছাই করে যদি পরস্পরে সম্পর্কচ্ছেদ করানো যায়, তাহলে তার জীবনটা হয়ে উঠে অনেকটা বিপন্ন এবং ব্যর্থ।

সমাজে একজন ব্যক্তির সম্পর্ক দু-ভাবে স্থাপিত হয়। এক আত্মীয়তা, দুই অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক। যেমন- প্রতিবেশী, খেলা ধুলার সাথী, সহপাঠী, বন্ধু, এবং ধর্মীয় সম্পর্ক ইত্যাদি। কিন্তু এর মধ্যে আত্মীয়ের সম্পর্কই সবচেয়ে মজবুত ও নিকটের। আত্মীয়ের আত্মিক অনুভূতির সন্ধান মেলে সুখে-দুঃখে ও বিভিন্ন অনুকূল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। বিপদের মুহূর্তে আত্মীয় যেভাবে সাড়া দেয়, অন্য কারো পক্ষে সেরকম সাড়া দেয়া সম্ভব হয় না,আর অন্য কেউ সারা দিতেও চাইনা একজন আত্মীয় অন্য আত্মীয়দের সুখে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে, অন্যরা তা করবে না। তাই সমাজে বেঁচে থাকার জন্য আত্মীয়ের সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। এক আত্মীয়ের অন্তরে অন্য আত্মীয়ের দুঃখের জ্বালা এবং সুখের জোয়ার থাকবেই। আত্মীয় ছাড়া মানুষের পক্ষে সামাজিক জীবন পরিচালনা করা কঠিন ব্যাপার।

আত্মীয়তা দু’ধরনের হয়ে থাকে, নিকটাত্মীয় এবং দূরাত্মীয়। নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি দূরাত্মীয়ের অনুভূতির চেয়ে অপেক্ষাকৃত মজবুত। মূলত: আত্মীয়তার পাঁচটি উৎস রয়েছে। এক. মায়ের দিকের আত্মীয়; যেমন- নানা-নানী, মামা ইত্যাদি। দুই. পিতার দিকের আত্মীয়; যেমন- চাচা-চাচী, দাদা-দাদী, ভাই-বোন ইত্যাদি। তিন. বিয়ের সম্পর্কের আত্মীয়; যেমন- শশুর-শাশুড়ী, শ্যালক-শ্যালিকা, দেবর ইত্যাদি। চার. নিজের সম্পর্কের আত্মীয়; যেমন- ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনী, ভাতিজা-ভাতিজী, ভাগনী ইত্যাদি। পাঁচ. দুধ সম্পর্কের আত্মীয়; যেমন- দুধ মাতা, দুধ পিতা, দুধ ভাই-বোন ইত্যাদি। এভাবে আত্মীয়তার ধারা বাড়তে থাকবে। তবে নিকটাত্মীয় দূরাত্মীয়ের চেয়ে অধিকতর অধিকারী; সম্পর্ক অক্ষুন্ন এবং অটুট রাখার। যেমন- মাতা-পিতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, খালা-মামা, ফুফু ইত্যাদি।

ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামের অনুসারী কোন মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্খা পোষণ করলে তাকে অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। এক কথায় আত্মীয়দের প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা পোষণ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আন্তরিকতা, সাহায্য এবং উপদেশ দিয়ে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে। কোরআন পাকে আল্লাহ তাআলা বলেন- আর আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাঞ্চা করে থাক এবং আত্মীয়-জ্ঞাতীদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। (নিসা- ১ আয়াত)। হাদীস শরীফে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মহানবী হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার রিযিকের প্রাচুর্য এবং দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশা করে, তার উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা। (মিশকাত- ৪১৯)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে সালাম (রাযি.) বলেন, প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের প্রায় সাথে সাথেই আমিও তাঁর দরবারে গিয়ে হাজির হলাম। সর্বপ্রথম আমার কানে তাঁর যে কথাটি প্রবেশ করল, তা হলো এই- হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর পরস্পরকে বেশী করে সালাম দাও। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষকে খাদ্য দান কর। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোল এবং এমন সময়ে নামাযে মনোনিবেশ কর, যখন সাধারণ লোকেরা নিদ্রামগ্ন থাকে। স্মরণ রেখো, এ কথাগুলো পালন করলে তোমরা পরম সুখ ও শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (মিশকাত)। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দেন, আল্লাহ তাআলা সবার সাথে ন্যায় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করার জন্য। (সূরা নাহল- ৯০ আয়াত)। আলোচ্য আয়াতাংশে সদ্ব্যবহার করার সাথে সাথে সামর্থানুযায়ী আত্মীয়-আপনজনদের আর্থিক সেবা-যত করা, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খবরা-খবর নেয়াও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

হযরত সালমান ইবনে আমের (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, সদকার মাল সাধারণ গরীব-মিসকীনকে দান করলে তাতে তো শুধু সদকার সাওয়াবই পাওয়া যায়। অথচ তা যদি নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনকে দান করা হয়, তাহলে তাতে দুটি সাওয়াব পাওয়া যায়। একটি হল সদকার সওয়াব এবং আরেকটি হলো আত্মীয়তার হক আদায় করার সাওয়াব। উল্লিখিত আয়াতে প্রথমে পিতা-মাতার হক্বের ব্যাপারে তাকীদ দেয়া হয়েছে এবং তার পরেই আত্মীয়-স্বজনের হক্বের কথা বলা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- (বিপদগামী ওরাই) যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ তাআলা যা অবিচ্ছিন্ন রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে, আর পৃথিবীর বুকে অশান্তি সৃষ্টি করে। ওরা যথার্থই ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা বাক্বারাহ- ২৭)। উল্লিখিত আয়াত থেকে বুঝা যায়, যে সব সম্পর্ক শরীয়ত বহাল রাখতে বলেছে, তা বজায় রাখা একান্ত আবশ্যক এবং তা ছিন্ন করা সম্পূর্ণ হারাম।

গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, একজন মানুষের প্রতি আল্লাহর এবং অন্যান্য মানুষ তথা সৃষ্টি কূলের, অধিকার ও প্রাপ্য আদায় করার নির্ধারিত পদ্ধতি ও তৎ সংশ্লিষ্ট সীমার নামই দ্বীন বা ধর্ম। বিশ্বের শান্তি ও অশান্তি এসব সম্পর্ক যথাযথভাবে বজায় রাখা বা না রাখার উপরই নির্ভরশীল। অন্য এক হাদীসে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী বেহেস্তে প্রবেশ করবে না। আশ্চর্য বিষয় কত বড় শাস্তির হুঁশিয়ারী বাণী উচ্চারণ করেছেন রাসুলুল্লাহ (সঃ) অথচ এদিকে কী আমরা একটুও খেয়াল করি? আমরা আমাদের নিজেদের কে নিয়ে চিন্তার জগতকে ডুবে আছি অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত ঐতিহাসিক একটি ঘটনা হচ্ছে, ষষ্ঠ হিজরী সনে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী মুস্তালিম নামান্তরে মুরায়সী যুদ্ধে গমন কালে বিবিদের মধ্যে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.) সাথে ছিলেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার সময় ঘটনা ক্রমে মা আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.) পেছনে পড়ে যান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালনে সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল কাফেলার পশ্চাতে ফিরার পথে হযরত আয়েশা (রাযি.)কে দেখে বিস্মত হলেন এবং সাথে নিয়ে এলেন। এদিকে মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই সুবর্ণ সুযোগ মনে করে মা আয়েশার পূতঃ পবিত্র চরিত্রের প্রতি অনর্থক অপবাদ আরোপ করলো এবং হাস্সান, মিমতা, হামনাহ কয়েকজন সরলমনা মুসলমানকে শামিল করালো তার স্বপক্ষে। অবশ্য তাদের প্রতি হদ বা শাস্তি জারী হয়েছিল এবং মা আয়েশার পবিত্রতা ও সতীত্ব বর্ণনা করে আয়াত নাযিল হয়েছে। এখানে আসল কথা যেটা আমার বর্ণনার উদ্দেশ্য ছিলো, সেটা হলো- মিসতাহ হযরত আবু বকর (রাযি.)এর আত্মীয় ছিলো এবং গরীব ছিলো। যার কারণে হযরত আবু বকর (রাযি.) তাকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করতেন। যখন তার মেয়ের প্রতি অপবাদ কারীদের মধ্যে সে শামিল হয়ে পড়ল, তখন তিনি তার প্রতি আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল করে তা অব্যহত রাখার বিশেষ তাকীদ প্রদান করেছেন। এ দ্বারাও বুঝা যায় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা কতইনা গুরুত্বপূর্ণ।