পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)-এর বহু গুণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যার প্রতিটিই আপন আপন জায়গায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হলো, মহান আল্লাহ তাঁকে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্য রহমতস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর আমি আপনাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
কয়েক শব্দের এই পবিত্র আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধুকে কত বড় মর্যাদা দিয়েছেন, তা মানব মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করা দুষ্কর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু আছে, কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু আসবে, মানুষ, জিন থেকে শুরু করে যত ধরনের প্রাণী আছে এবং আসবে, সব কিছুর জন্য আমাদের নবীজি (সা.)-কে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধুকে এভাবেই সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত করেছেন। তাঁর মাধ্যমে পৃথিবী থেকে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, জুলুম-অত্যাচার, সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ইত্যাদির মূলোৎপাটন করেছেন। নিম্নে তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
একত্ববাদের ধারণা : মহান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুলের মাধ্যমে মানুষকে একত্ববাদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেওয়া হয়নি।
এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।’
(সুরা : ইখলাস, আয়াত : ১-৪)
মহানবী (সা.)-এর আগেও বহু নবী-রাসুল একত্ববাদের দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের ধর্মের বহু লোক পরবর্তীতে তা থেকে সরে গেছে। তারা আল্লাহর সঙ্গে শিরকে লিপ্ত হয়েছে। এবং তাকেই মুক্তির পথ বলে দাবি করেছে। অথচ আল্লাহর মনোনীত ধর্মে শিরকের কোনো স্থান নেই। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ইহুদিরা বলে, ‘উজায়র আল্লাহর পুত্র। আর নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এসব তাদের মুখের কথা। এতে তারা তাদের পূর্বেকার কাফিরদের কথারই অনুকরণ করে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন! কেমনভাবে তারা সত্য পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩০)
এখানে মহান আল্লাহ নিজেই পূর্ববর্তী ধর্মের মানুষদের সত্য থেকে ছিটকে পড়ার চিত্র তুলে ধরেছেন। এবং নবীজি (সা.)-এর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের একত্ববাদের দিকে ফিরে আসার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যখন এ আয়াতে কারিমা অবতীর্ণ হলো—‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুমের দ্বারা কলুষিত করেনি। তখন তা মুসলিমদের পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। তারা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি আছে যে নিজের ওপর জুলুম করেনি? তখন নবী (সা.) বলেন, এখানে অর্থ তা নয় বরং এখানে জুলুমের অর্থ হলো শিরক। তোমরা কি কোরআনে শোনোনি লুকমান তাঁর ছেলেকে নসিহত দেওয়ার সময় কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার বৎস! তুমি আল্লাহর সঙ্গে শিরক কোরো না। কেননা, নিশ্চয়ই শিরক এক মহা জুলুম।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৪২৯)
সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা : বিশ্বনবী (সা.)-এর আগমনের আগে পৃথিবীতে মানুষের মাঝে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছিল, কেউ বংশীয় কারণে জন্মসূত্রে সম্মানিত হতো, কেউ আবার নিম্ন বংশে জন্ম নেওয়ার অপরাধে জন্মসূত্রে তার প্রাপ্ত সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো, কেউ তার সাদা বর্ণের কারণে নিজেকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠ ভাবত, কেউ আবার কালো বর্ণের কারণে মানুষের তিরস্কার ও অবহেলার শিকার হতো। আবার নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র বংশ ও সম্পদকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। মানুষের বৈষম্যের এই দেয়াল সমাজে বহু জুলুম-অত্যাচারের জন্ম দিয়েছিল। নবীজি (সা.) এসে সেই বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো! আরবির ওপর অনারবির এবং অনারবির ওপর আরবির, কৃষ্ণকায়ের ওপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের ওপর কৃষ্ণকায়ের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল ‘তাকওয়া’র ভিত্তিতেই। (মুসনাদে আহমদ)
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতি খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানী বলেন, বর্তমান দুনিয়ায় গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, তার ধারণা মূলত বিশ্বনবী (সা.)-এর এই নীতি থেকে নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার বিকাশে কাজ করেছেন : নবীজি (সা.) যে সমাজে এসেছিলেন, সে সমাজে শিক্ষার আলো ছিল না, বরং সে সমাজের মানুষ শিক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার ওপর অহংকার করত। তিনি এসে তাদের সেই ধারণা ভেঙে দেন। শুধু কোরআন-হাদিসের শিক্ষাই নয়, মানুষের কল্যাণে কাজে আসে এমন সব শিক্ষার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করতেন। শিশুদের দক্ষ করতে তিনি বদরে বন্দি হওয়া কয়েদিদের দিয়েও শিশুদের পাঠদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৫/১৬১)
কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে করেছেন : নবীজি (সা.)-এর আগমনের আগে জাহেলি সমাজে বিভিন্ন জিনিসকে অলক্ষুনে ভাবা হতো, যেমন—তারা মানুষের মধ্যে নারী/কন্যা সন্তানকে অলক্ষণ ভাবত, আল্লাহর রাসুল (সা.) এসে বলে দিলেন, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে কন্যাসন্তানের অধিকার আদায় করবে, সে জান্নাতে নবীজি (সা.)-এর কাছাকাছি থাকবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯১৪)
এ ছাড়া তারা পশুর মধ্যে গাধা, পাখির মধ্যে পেঁচা, দিনের মধ্যে বুধবার ও মাসের মধ্যে সফর মাসকে কুলক্ষণ ভাবত। নবীজি (সা.) বিভিন্ন হাদিসে এই ধারণাগুলোর শক্ত বিরোধিতা করেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৫৬৮১, আদাবুল মুফরাদ, হাদিস :৯২২)
ধর্মীয় গোঁড়ামি নিষিদ্ধ করেছেন : ইসলাম আসার আগে বিভিন্ন ধর্মে নিজেদের তৈরি করা বাড়াবাড়ি ছিল, তারা বিয়েকে ইবাদতে বিঘ্নতাকারী মনে করত, হালাল রিজিকের জন্য মেহনত করাকেও আল্লাহর দ্বিন থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া মনে করত, কেউ কেউ তো বৈরাগ্য অবলম্বন করে, অজু, গোসল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদিকেও অপ্রয়োজন মনে করত। ইসলাম এসে এ সমস্ত গোঁড়ামি নিষিদ্ধ করে দেয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বিয়ে আমার সুন্নত, যে আমার সুন্নত মোতাবেক কাজ করল না, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮৪৬, তিরমিজি, হাদিস : ১০৮০)