বর্তমান বিশ্বে কম-বেশি আল্লাহর গজব বিরাজমান , গজব আমাদের অধর্মীয় কর্মকাণ্ড বা পাপাচারের কুফল যা আল্লাহর গজব, ফলে তা আমাদের স্বহস্তের অর্জন। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে।(সূরা রুম-৪১)
দেশে-বিদেশে আল্লাহর গজব দৃশ্যমান যথা- সম্প্রতি তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্প, আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস, ডেঙ্গুজ্বর, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাবানল, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি। আল্লাহর গজব তাঁর ক্রোধানলের বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহর আদেশ-নিষেধাজ্ঞা পালন না করা আল্লাহর ক্রোধের কারণ। আমরা প্রতিনিয়ত তার আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা অনেকাংশে পালন করছি না। আমাদের অবশ্যই করণীয় যথা- সালাত, জাকাত, হজ, রোজা (ফরজ ইবাদতসমূহ), ন্যায়বিচার, ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ, সত্য বলা ইত্যাদি সৎকাজ এবং যা অবশ্যই বর্জনীয় যথা- হারাম অর্জন, জুলুম-নির্যাতন, অত্যাচার-অবিচার, ব্যভিচার, মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, অসদাচরণ, অন্যান্য নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ইত্যাদি যা আল্লাহর ক্রোধানলকে প্রজ্বলিত করে। ফলে অশান্তি ও অশান্ত পরিবেশ ব্যাপকহারে আমাদের মধ্যে বিরাজমান। স্মরণে রাখা বাঞ্ছনীয়, যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তা সাধনে আমরা অনেকাংশে উদাসীন। ফলে মহাবিশ্বের স্রষ্টা আমাদের উপর ক্রোধান্বিত হবেন এটিই স্বাভাবিক এবং হচ্ছেনও তাই। আমাদেরকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহর বাণীতে প্রকাশিত- তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে আবির্ভূত করা হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো (বিরত রাখো) ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো। (সূরা আলে-ইমরান-১১০) আল্লাহর এই বিধান পালন করা মানে ব্যাপক হারে জনকল্যাণ সাধন করা, মানবজাতিকে ধার্মিক হওয়ার শক্তি ও সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে। আমরা যদি এ দায়িত্ব পালন না করি তাহলে আমাদের পরিণতি ভয়াবহ তার চূড়ান্ত প্রমাণ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ রাসূল সা:-এর সতর্কবাণী। যথা-হজরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রা: নবী করিম সা: থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন, অবশ্যই তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় ও পাপকাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে নতুবা তোমাদের ওপর শিগগিরই আল্লাহর গজব নাজিল হবে। এরপর তোমরা (তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য) দোয়া করতে থাকবে কিন্তু তোমাদের দোয়া কবুল করা হবে না।(তিরমিজি-২০৯৫)
আমরা যদি উপরোক্ত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে থাকি অর্থাৎ যথাসাধ্য সম্মিলিতভাবে ব্যাপক হারে শান্তির উৎস সৎকাজের আদেশ, উপদেশ ও পরামর্শ উদাসীন মানবজাতিকে দিতে না থাকি এবং অশান্তি, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার উৎস নিষিদ্ধ বা মন্দ কাজ থেকে তাদের বিরত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা না করি তাহলে আল্লাহর গজব বাড়তেই থাকবে যা উপরোক্ত হাদিস দ্বারা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত, এমনকি গজবমুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের দোয়াও কবুল হবে না। বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলের অসহনীয় দুরবস্থা এর বাস্তব উদাহরণ।
সৎকাজসমূহ ও সৎগুণাবলির মধ্যে একটি কাজ এবং একটি গুণ আল্লাহ উল্লেখ করেছেন আমাদের ব্যাপক কল্যাণ সাধনের জন্য। আলোচ্য কাজটি হলো-পরস্পর পরস্পরকে যথাসাধ্য সদা-সর্বদা সৎকাজ ও সত্য সম্পর্কে উপদেশ-আদেশ ও পরামর্শ দিতে থাকা। আলোচ্য গুণটি হলো ধৈর্য ধারণ করা। পরস্পর পরস্পরকে যথাসাধ্য সদা-সর্বদা সুযোগ পেলেই ধৈর্য অবলম্বনের আদেশ-উপদেশ ও পরামর্শ দিতেই থাকা। প্রমাণ আল্লাহর বাণী, মহাকালের শপথ! নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে। (সূরা আল-আসর : ১-৩)
এ সূরার শেষ অংশটুক একটি অসাধারণ মহৎকাজ ও একটি শীর্ষস্থানীয় মহৎগুণ পরম করুণাময় আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যা আমাদের অবশ্যই পালনীয় ব্যাপক কল্যাণ সাধন ও প্রাপ্তির স্বার্থে।
আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আমাদের অধীনস্থদেরকে তাদের ধর্মীয় আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করানোর ব্যাপারে অবশ্যই আমাদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে। সদুত্তরে মুক্তি অন্যথায় শাস্তি যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন। চূড়ান্ত প্রমাণ রাসূল সা:-এর মহামূল্যবান বাণী-হজরত ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল; সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি)
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাসমূহ পালনে অর্থাৎ যে কর্মকাণ্ডের আদেশ করেছেন তা সুচারুরূপে পালন করা এবং নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডসমূহ পুরোপুরি বর্জন করার মধ্যেই নিহিত আছে সর্বস্তরে অবিরাম শান্তির প্রবাহ মহাসমুদ্রের স্রোতের ন্যায়। অন্যথায় অশান্তি আর অশান্তি যথা যুদ্ধ-বিগ্রহ, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, ঝগড়া-ফাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, খুনাখুনি, মামলা-মোকাদ্দমা ইত্যাদি যা আল্লাহর গজব বৈ অন্য কিছু নয়।
সত্যিকার ধর্মপ্রাণ মুসলিম বিশেষ করে যদি ধর্মীয় জ্ঞানে মোটামুটি জ্ঞানী হন সে ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের অশান্তির কারণ সাধারণত হতে পারেন না। যারা অশান্তির কারণ হয় তারা যথাযথ ধার্মিক নয় এবং ধর্মীয় জ্ঞানে সাধারণত জ্ঞানীও নন।
আল্লাহর গজব নিপতিত হতে পারে ব্যক্তি বিশেষ, সব লোক বা অঞ্চলের উপর যথা- কারুন, ফেরাউন এবং তার সৈন্যবাহিনী। অঞ্চলের উপর যথা- ১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর আমাদের দেশে দক্ষিণাঞ্চলের ওপর অভূতপূর্ব জলোচ্ছ্বাস পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত মানুষ ও গবাদিপশুসহ অসংখ্য প্রাণহানি হয়েছিল। গজব কাকে বলে! ভূমিকম্প বা দাবানল এলাকা বিশেষ, অভূতপূর্ব প্লাবন যথা- কাওমে নুহ আ:-এর অবাধ্যদের সামগ্রিক ধ্বংসলীলা।