রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল তারাবীর নামায। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি রমজান মাসে সওয়াবের আশায় কিয়ামে রমজান আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তার পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। (সহীহ বুখারী : ২০০৯)। আরো একাধিক হাদিসে কিয়ামে রমজান তথা তারাবীর নামাযের কথা বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে এ সুন্নতের ওপর আজও মুসলিম উম্মাহর আমল চলে আসছে। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে মুসলিম জনপদগুলোতে রমজান মাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তারাবী আদায় করা হচ্ছে। রাসূলের সুন্নাহ অনুসারী কোনো মুসলিম কখনো এ আমলকে গুরুত্বহীন বা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। কিন্তু আজকাল দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মতো অনেকের মধ্যে এ মহান আমলের প্রতিও গুরুত্বহীনতা ও অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনো কোনো ভাইকে দেখা যায়, নিজের মনমতো যেদিন যত রাকাত ইচ্ছা পড়ে নেয়। কেউ আবার জামাতে শরীক না হয়ে একা একা কিছু রাকাত পড়ে নেয়, কেউ তো মোটেই পড়ে না। অথচ তারাবীর নামায সুন্নতে মুআক্কাদা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর রমজানের সিয়াম ফরয করেছেন এবং আমি (আল্লাহ তাআলার হুকুমে) কিয়ামে রমজান (অর্থাৎ তারাবীর নামায)-এর বিধান জারি করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের উদ্দেশে রমজানের রোযা রাখবে এবং রাতে নামায (তারাবী) পড়বে সে যাবতীয় গুনাহ থেকে নবজাতক শিশুর মতো পবিত্র হয়ে যাবে। (মুসনাদে আহমাদ : ১৬৬০)।
অত্যন্ত সওয়াবের এ আমলে নিজের খেয়ালখুশি মতো কম করা মূলত নামাযের প্রতিই অবহেলা-অনাগ্রহের প্রকাশ এবং এর মন্দ প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। মুসলিম ঐতিহ্যের এ মহান আমলকে কম গুরুত্বের মনে করে এ ব্যাপারে অবহেলা করতে থাকলে আল্লাহ না করুন, আমাদের কুপ্রবৃত্তি ধীরে ধীরে আমাদেরকে এ সুন্নত থেকে পুরোপুরিই উদাসীন করে ফেলতে পারে।
মনে রাখা দরকার, আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দার নেক আমলের সওয়াব এমনিতেই বহু গুণে বাড়িয়ে দেন। রমজান তো আরো মর্যাদাপূর্ণ মাস। এ মাসের ফযীলত ও আমলের সওয়াবও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। কাজেই আমরা আল্লাহ প্রদত্ত সওয়াব অর্জনের এ সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাই এবং এর যথাযথ কদর করি।
তারাবীর নামাযের ব্যাপারে আমাদের কোনো কোনো ভাইয়ের উদাসীনতার একটা বড় কারণ হলো, তারাবীর নামাযের বিধান এবং এর রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিগত শতাব্দী থেকে কোনো কোনো মহল কর্তৃক বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস। অথচ তাদের বক্তব্যের কোনো দালীলিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তারা যে সকল বর্ণনা দ্বারা দলীল দিতে চেষ্টা করে, তা তাদের বোঝার ভুল। যা উলামায়ে উম্মত বিস্তারিতভাবে খ-ন করেছেন। আর ঐতিহাসিকভাবে তো তাদের কোনোই দলীল-প্রমাণ নেই। সে আলোচনা এখানে বাঞ্ছনীয় নয়। মূলত এক্ষেত্রে অযথা বাড়াবাড়িই তাদের মতবিরোধের মূল কারণ।
তাদের এমন প্রোপাগান্ডার ফলে কারো কারো কাছে তারাবীর নামাযের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। অথচ সালাফের যুগ থেকে অনুসৃত সকল ইমামের ঐক্যমতে তারাবীর নামায সুন্নতে মুআক্কাদা এবং তা বিশ রাকাত। হাজার বছর ধরে এর ওপরেই আমল হয়ে আসছে। (দ্র. জামে তিরমিযী ১/১৬৬)।
তারাবীর নামাযের প্রচলন সম্পর্কে আপাতত কেবল এতটুকু উল্লেখ করছি, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) পরপর তিন দিন কিয়ামে রমজান তথা তারাবীর নামায জামাতের সাথে আদায় করেছেন। চতুর্থদিন যখন দেখলেন, তারাবীর জামাতে শরীক হতে সাহাবায়ে কেরাম প্রায় সকলেই মসজিদে উপস্থিত হয়েছেন। তখন আর জামাত করেননি। পরদিন ফজর নামাযের পরে সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আমি তোমাদের আগ্রহ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি আশঙ্কা করছি, এতে করে এ নামায তোমাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে, তখন তোমাদের জন্য তা আদায় করা কষ্টকর হবে। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদিস ২০১১, ১০১২)।
উক্ত আশঙ্কায় নবীজী (সা.) নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবীর নামাযের সম্মিলিত জামাতের ব্যবস্থা করেননি। আবু বকর (রা.)-এর দুই বছরের খেলাফতকালেও তারাবীর সম্মিলিত জামাতের ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে ছোট ছোট জামাতে তারাবী আদায় করা হতো।
উমর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে সাহাবায়ে কেরামের সম্মতিতে তারাবীর সম্মিলিত জামাতের ব্যবস্থা করেন। তিনি দেখলেন, মসজিদের বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদাভাবে তারাবীর জামাত হচ্ছে। তিনি সবাইকে নিয়ে একত্রে একটি জামাতের ব্যবস্থা করতে চাইলেন। তখন উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর ইমামতিতে সকলের একত্রে তারাবী আদায়ের ব্যবস্থা করলেন। (দ্র. সহীহ বুখারী : ২০১০)।
ইমাম ইবনে আবদুল বার (রাহ.) (মৃত্যু : ৪৬৩ হি.) বলেন, উমর (রা.) নতুন কোনো কিছুর প্রচলন ঘটাননি। তারাবী রাসূলুল্লাহ (সা.) পড়েছেন এবং জামাতেও পড়েছেন। কিন্তু এই আশঙ্কায় নিয়মিত জামাতের ব্যবস্থা করেননি যে, তিনি জামাতের ব্যবস্থা করলে তা উম্মতের জন্য ফরয হয়ে যেতে পারে। তবে নবীজীর এটি পছন্দ ছিল। তাঁর পছন্দ অনুযায়ীই উমর (রা.) এ সুন্নত নিয়মিত জামাতে আদায়ের ব্যবস্থা করেন। (আততামহীদ ৮/১০৮-১০৯)।