Islamic News BD - The Lesson of Peace
কোরআনের বর্ণনায় আদর্শ নেতার গুণাবলি
রবিবার, ২৫ আগস্ট ২০২৪ ০০:৪০ পূর্বাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

নেতৃত্ব হলো এমন একটি গুণ, যা মানুষকে তার আচরণের মাধ্যমে প্রভাবিত করে সুসংগঠিতভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা ও আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিথ ডেভিসের মতে, ‘নেতৃত্ব হলো মানুষের এমন এক ধরনের ক্ষমতা বা গুণ, যা অন্যদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে উৎসাহিত করতে পারে।’

নেতৃত্বগুণ হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি বা জন্মগত। আর নেতৃত্বকে শাণিত করে জ্ঞানচর্চা ও অনুশীলন। আদর্শ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে যোগ্য নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিহার্য। সঠিক নেতৃত্বের ফলে একটি জাতি তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করতে পারে। আবার দুর্বল বা অযোগ্য নেতৃত্ব জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে। আমরা যুগে যুগে বহু শাসক দেখেছি, যারা একটি সুশৃঙ্খল জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। কিন্তু নবী ও রাসুলদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিসহ ইতিহাসের পরতে পরতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা কিছু শাসকের নাম আমরা শুনেছি। যাঁরা যোগ্য নেতৃত্বের আদর্শের প্রতীক। কী সেই গুণাবলি, যা অর্ধপৃথিবী শাসন করতে পারে? আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সময়ের কসম। নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সুরা : আসর, আয়াত : ১-৩)

 

নিম্নে যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো—

১. প্রয়োজনীয় জ্ঞান

একজন সফল নেতাকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ অনুধাবন করে সুকৌশলে সব কিছু মোকাবেলা করার মাধ্যমে অনুসারীদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এ জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কেননা এগুলো নেতার শক্তি সঞ্চার করে এবং অনুসারীদের আনুগত্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে, যা কাঁটাযুক্ত পথ চলতে সহজ করে। এ ছাড়া নেতাকে সাংগঠনিক ও অনুসারীদের সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি। 

সাংগঠনিক ও অনুসারীদের সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে কাজ অনুযায়ী উপযুক্ত কর্মী বাছাই, বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে কাজ বিভক্তিকরণ, দায়িত্ব বণ্টন, সুসম্পর্কের জন্য যোগাযোগ, কার্যকর সমন্বয় সাধন এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে না। আর অনুসারীদের শক্তি-সামর্থ্য, চাওয়া-পাওয়া, আনুগত্যের প্রমাণ, মনমানসিকতা ও  চিন্তা-চেতনা বিবেচনায় না নিয়ে কাজ করলে সেই নেতৃত্ব কখনো সফল হতে পারবে না। অনেক ক্ষমতাধর হয়েও নেতৃত্বগুণের অভাবে বহু শাসক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এ জন্য যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অত্যাবশ্যকীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলো, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?  বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ৯)

২. ব্যক্তিত্ববোধ

নেতৃত্বের জন্য ব্যক্তিত্ব খুবই দরকার। ব্যক্তিত্ব হলো ভাবগাম্ভীর্যতা, বুদ্ধিবৃত্তিক বাক্যব্যয়, মোহনীয় আচরণ এবং আন্তরিকতার মতো বিশেষ গুণাবলি। ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে অনুসারীদের মনে শ্রদ্ধাবোধ ও ইচ্ছাশক্তির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। আলী (রা.) বলেন, ‘মানুষের নেতৃত্বদানের অধিকারী হবে সে, যে তাদের সবার তুলনায় অধিক দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও বেশি শক্তিশালী হবে।’ (আল-ইসলাম : ২/১৪৮)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের ধন-সম্পদ দিয়ো না, যাকে আল্লাহ তোমাদের জন্য করেছেন জীবিকার মাধ্যম।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫)

৩. দূরদর্শিতা

একজন দক্ষ নেতাকে অবশ্যই প্রজ্ঞাবান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। কেননা নেতা অতীত ও বর্তমানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুসারীদের সুস্পষ্ট ধারণা না দিতে পারলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। একই সঙ্গে জনশক্তি মনোবল হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যা নেতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। নেতাকে পরিবেশের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য চিন্তা-ভাবনা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো। নিশ্চয়ই একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)

৪. আত্মবিশ্বাস

নিজেকে চিনতে পারলে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। আত্মবিশ্বাস কঠিন পরিস্থিতিতে মনোবল না হারিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। সফলতা অর্জনের জন্য আত্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিকূল পরিবেশে নেতার দৃঢ়বিশ্বাস, আল্লাহর ওপর ভরসা ও সাহায্য কামনা অনুসারীদের সংখ্যা কম হলেও বিজয় সুনিশ্চিত। বদর যুদ্ধে মহানবী (সা.) আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে কাফিরদের এক হাজার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে নিশ্চিত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)

৫. ধৈর্যশীল হওয়া

সফল নেতৃত্বের অন্যতম গুণ হলো ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতা। প্রতিকূল পরিবেশে নেতাকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। কখন কোন কাজ করতে হবে, আবার কখন বিরত থাকতে হবে, সেটা জানতে হবে। কিন্তু এই কাজ বড়ই কঠিন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধরো। নিশ্চয়ই এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৭)

৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা

সফলতা অর্জনের মহা মন্ত্র হলো যথাসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। নেতা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত যথাসময়ে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে অনুসারীদের মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধে। মহানবী (সা.) ত্বরিত সিদ্ধান্তে হুদায়বিয়ার সন্ধি গৃহীত হয়। সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিবর্তনে পরিস্থিতি শীতল হয়ে যায়। আবার দেখা যায়, সিদ্ধান্তহীনতায় অনুসারীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়। প্রতিকূল পরিবেশে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেতার জন্য আবশ্যক।

৭. ন্যায়পরায়ণতা

ন্যায়পরায়ণতা নেতার জন্য একটি আবশ্যক গুণাবলি। অনুসারীদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে না পারলে নেতার গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা হ্রাস পায়। তাই নেতাকে অবশ্যই সৎ, বিশ্বস্ত, ভাষার দৃঢ়তা, কাজে স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পরিহারসহ আমানত তথা প্রাপ্য ব্যক্তিকে যথাযথভাব বুঝিয়ে দেওয়া আবশ্যক। কারণ কাজের প্রতি নিষ্ঠাই একজন মানুষকে বিজয়ের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফায়সালা করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কতই না সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

৮. মানবিক ও নমনীয় মনোভাব

নেতাকে অবশ্যই মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধে সচেতন হতে হবে। অনুসারীদের মতামত ও পরামর্শ নম্রচিত্তে গ্রহণ করতে হবে। তারপর পরিস্থিতির আলোকে এগিয়ে যেতে হবে। নেতার একগুয়ে স্বভাব সংগঠনের সুন্দর কর্মপরিবেশ বিনষ্ট করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের ও কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে, তাহলে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)