Islamic News BD - The Lesson of Peace
শিশুদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.)
সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০১:১০ পূর্বাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

শিশুরা আল্লাহর দেওয়া খুশবু। ওরা ফুলের মতো। জাতিসংঘ শিশুদের রক্ষায় বিশ্বজনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অথচ তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অহরহ শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে দেশে দেশে। 

আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ সারা বিশ্বে কত শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। এদের জন্য দরদি জাতিসংঘের একবারও প্রাণ কাঁদে বলে মনে হয় না। আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহার ও হত্যা না করার নির্দেশ দিয়েছেন। 

বদর যুদ্ধের সময় কিছু বালক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাসূল (সা.) তাদের জিহাদি প্রেরণা দেখে খুশি হলেন। কিন্তু তাদের ঘরে ফিরে যেতে বললেন। অবশ্য উমাইয়ার নামক একটি শিশুর দৃঢ় সংকল্পের জন্য শেষে তাকে যুদ্ধে যেতে অনুমতি দেন। অন্য এক যুদ্ধে কয়েকজন শিশু মারা যায়। তারা ছিল শত্রুপক্ষের। 

এ খবর এসে পৌঁছলে রাসূল (সা.)-এর প্রাণ কেঁদে ওঠে। তিনি খুবই আফসোস এবং দুঃখ করতে থাকেন। এ অবস্থা দেখে একজন সৈনিক বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী। আপনি যাদের জন্য এত মর্মবেদনা ভোগ করছেন তারা অমুসলিমদের সন্তান। 

 

নবীজী (সা.) রাসূল তার কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘এখন থেকে সাবধান হও। কখনও শিশুদের হত্যা করবে না। প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ ফুলের মতো।’ আমরা যেন শিশুদের আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ঢাল হিসেবে ব্যবহার না করি। 

শিশুরা আল্লাহর সাজানো বাগানের ফুল। ফুল দেখলেই যেমন মানুষ তার ঘ্রাণে মোহিত হতে চায় তেমনি মানববাগানের ফুল দেখেও মানুষ আনন্দিত হয় চক্ষু শীতল করে। শিশুরা মমতার আধার। শিশুদের আদর-স্নেহ করা সুন্নতে নবী। নবীজী তার দৌহিত্রকে ভরা মজলিসে স্নেহের চুম্বন দিয়ে আমাদের তা শিখিয়েছেন। 

একদা নবীজী (সা.) নাতি হাসানকে চুমু খাচ্ছিলেন তা দেখে আকবা বিন হারেস নামে এক সাহাবি নবীজীকে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আপনি শিশুদের দেখে এত আনন্দিত হন এবং আদর স্নেহ করেন তারাও আপনার আদরে আপ্লুত হয় আমার তো অনেক সন্তান কিন্তু তাদের আপনার মতো স্নেহ করতে পারি না, নবীজী বলেন, তোমার হৃদয়ে স্নেহ মমতা না থাকলে আমার কী করার আছে? 

মুসলিম শরিফে আছে, একদিন নবী একদল শিশুর সঙ্গে আনন্দ করছেন। শিশুরাও নবীজীকে ঘিরে আনন্দ খুশিতে মেতে ওঠে। এমন সময় সেখানে এক বেদুঈন এসে উপস্থিত হয়। সে নবীজীকে বলে, শিশুদের নিয়ে এমন আমোদ আহ্লাদ করা আমার পছন্দ নয়। এ কথা শুনে নবীজীর হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে যায়। তিনি বললেন, যে ব্যক্তির হৃদয়ে মায়া দয়া নেই, আল্লাহ যেন তাকে দয়া করেন না। 

রাসূল (সা.) কখনও শিশুদের ওপর রাগ করতেন না। চোখ রাঙাতেন না। কর্কশ ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। তিনি ছোটদের আদর করে কাছে বসাতেন। তাদের সঙ্গে মজার মজার কথা বলতেন। ছোটদের দেখলে আনন্দে নবীজী তাদের বুকে জড়িয়ে ধরতেন। একদিন এক শিশুকে তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন, এই শিশুরাই তো আল্লাহর বাগানের ফুল। তিনি কখনও শিশুকে বিকৃত নামে ডাকতেন না। তিনি তাদের সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখতেন এবং মিষ্টি স্বরে সে নাম ধরে ডাকতেন। 

প্রিয় নবী শিশুদের যেমন আদর করতেন, তেমনি আবার তাদের সঙ্গে রসিকতাও করতেন। একবার সাহাবি আনাস-এর ছোট এক ভাইয়ের একটি পাখি মারা যায়। এতে তার মন খারাপ হয়। নবীজী তখন তাকে আদর করে কাছে ডেকে নিলেন। 

বললেন ‘ইয়া আবা উমায়েরু/ মা কা আলান নুগায়রু? হে আবু উমায়ের, তোমার পাখির ছানাটির কী হল? তখন নবীজীর মুখে ছন্দ ও সুর শুনে হেসে ফেলল। সফর থেকে ফেরার পর ছোট ছেলেমেয়েদের উটের সামনে পেছনে বসাতেন এবং তাদের সঙ্গে কৌতুক করে আনন্দ করতেন। শিশুদের প্রতি দয়ামায়া প্রদর্শন সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন ‘যে শিশুদের প্রতি দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না।’ 

নবীজীর কাছে শিশুদের কোনো জাত-পাত মুসলিম-অমুসলিম কোনো বিভেদ ছিল না। সব শিশুর প্রতি তাঁর সমান স্নেহবোধ ছিল। নবীজী বলেন ‘যে শিশুদের স্নেহ করে না আর বড়দের সম্মান করে না সে আমার উম্মত নয়’। 

নবীজী (সা.)-এর এ হাদিস থেকে বুঝা যায় শিশুদের প্রতি তিনি কতটা স্নেহপ্রবণ এবং দায়িত্বশীল ছিলেন। শিশু-কিশোর সে যে ধর্মেরই হোক না কেন তিনি তাদের আপন করে নিতেন। তাদের আবদার রক্ষা করতেন। দুনিয়ার যে কোনো সংগ্রামী বা বিপ্লবী নেতা নিজ দেশে টিকতে না পেরে ভিন্ন দেশে থেকে বিজয় লাভের পর নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছেন একমাত্র নবীজী মোহাম্মদই এর ব্যতিক্রম। 

মক্কা বিজয়ের পর তিনি নিজ মাতৃভূমি মক্কায় না থেকে তার আশ্রয় স্থাল মদিনাকেই সর্বশেষ ঠিকানা হিসেবে গ্রহণ করেন। এর মূল কারণ মদিনার শিশুকিশোরদের আবদারের কারণেই তিনি মদিনায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 

শুধু তাই নয়, মদিনায় আসার সময় শিশুকিশোরা তাকে স্বাগত জানিয়ে যে অভ্যর্থনা সঙ্গীত ত্বালা’আল বাদরু আলাইনা গেয়েছিল সেখানে মদিনা শব্দটি থাকায় নবীজী ইয়াসরিবের নাম মদিনা রাখায় সম্মতি দেন। 

শিশুদের খেলাধুলা ক্রীড়া উপকরণে নবীজীর সম্মতির প্রমাণ তার সিরাত বা জীবনইতিহাসে পাওয়া যায়। 

দশ বছরের বালক জায়েদ ইবনুল হারেসা উম্মুল মোমেনীন খাদিজাতুল কুবরার ক্রীতদাস। আরবের ঐতিহ্যবাহী ওকাজের মেলা থেকে তাকে কিনে নবীজীকে উপহার দেন। নবীজী মানুষকে দাস হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন না তাই তাকে মুক্ত করে দিয়ে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নিজ পরিবারভুক্ত করে রাখেন। 

একদা যায়েদকে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে লাকড়ি করার কুড়াল জাতীয় কিছু আনার জন্য পাঠিয়ে তিনি অপেক্ষা করছেন। এদিকে সময় যায় ঘণ্টা যায় যায়েদ ফিরছে না দেখে তিনি নিজেই সেখানে গিয়ে দেখেন যায়েদ সমবয়সীদের খেলা দেখছে আর মজা করছে। তিনি মুচকি হেসে যায়েদকে খেলা দেখতে সম্মতি দিয়ে নিজেই কুড়াল নিয়ে আসেন। 

নবীজীর এই শিক্ষা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমাদের ঘরে যে ছেলেটি সাংসারিক প্রয়োজনে ফুট ফরমায়েশ খাটে তাকেও বিনোদনের সুযোগ দেয়া নবীজীর সুন্নত। আমরা তো সুন্নতকে শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বেধে রেখেছি আর সামাজিক রীতি-নীতিতে নিজ মনগড়া স্বার্থভিত্তিক নিয়মকে চালু করে নিয়েছি। 

যায়েদ ক্রীতদাস হলেও তিনি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। শৈশবে লুটেরা কর্তৃক লুট হয়ে নিলামে উঠেছিলেন। তার পিতা যখন জানতে পারেন যায়েদ মক্কায় নবীজীর পরিবারভুক্ত হয়ে আছেন তাই তিনি মক্কা এসে তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে আসেন। নবীজী তার পিতার আবদার শুনে বলেন, আমার অধীনে আসার পরই যায়েদকে মুক্ত করে পালকপুত্র হিসেবে পরিবারভুক্ত করেছি সে যদি আপনার সঙ্গে স্বেচ্ছায় চলে যেতে চায় আমার কোনো আপত্তি নেই। 

এ কথা শোনার পর যায়েদ কান্না শুরু করে বাবাকে বলে আব্বু আপনি চলে যান মাকে গিয়ে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে বলবেন আমি ভালো আছি। জন্মদাতা হিসেবে আমাকে নিয়ে যাওয়ার অধিকার আছে কিন্তু আমি নবীজীর পরিবারে যে স্নেহমমতায় আছি তা ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছে না। 

উম্মুল মোমেনিন খাদিজাতুল কোবরার ইন্তেকালের পর আবু বকর তার মেয়ে আয়েশাকে নবীজীর সঙ্গে বিয়ে দেন, ওই সময় তার বয়স ছিল ছয় বছর যা আরব রীতিতে সিদ্ধ ছিল। কিন্তু শিশু থাকার কারণে নবীজী তাকে ওই সময় ঘরে না উঠিয়ে নয় বছর বয়সে ঘরে তোলেন। আয়েশা তার ব্যক্তিগত সরঞ্জামাদির সঙ্গে খেলার পুতুলগুলোও সঙ্গে নিয়ে এলে নবীজী তাকে বাধা না দিয়ে পুতুলের নাম-পরিচয় জানার সময় দেখেন একটি ঘোড়ার পাখা আছে। 

নবীজী বলেন ঘোড়ার আবার পাখা হয় নাকি। আয়েশা বলেন, আপনি জানেন না জিবরাঈল পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে জমিনে নামেন। পাখা না থাকলে ঘোড়া উড়বে কী করে? কথাটি শুনে নবীজী মুচকি হাসি দিয়ে তার কথায় সায় দেন। 

একদা মদিনায় চলছে ঈদের আয়োজন। ঘরে ঘরে নানা পদের খাবারের আয়োজন। শিশু-কিশোররা নতুন কাপড় পরে ঈদগা যাচ্ছে। নবীজী দেখেন পথে এক শিশু কাঁদছে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারে সে পিতৃহীন বালক সংসারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। তাই তার মা তাকে নতুন কাপড় দিতে পারছে না অথচ তার সমবয়সীরা রঙবেরঙের জামা-কাপড়ে সজ্জিত হয়ে ঈদগাহে যাচ্ছে। এজন্য মন খারাপ করে কান্না করছে। 

নবীজী তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে ঈদগাহে যাওয়া বাদ দিয়ে ঘরে ফিরে আয়েশাকে ডেকে বলেন, এ এতিম বালককে তোমার সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দাও আমি তাকে নিয়ে ঈদগাহে যাব। সে যেন মনে না করে পিতা না থাকায় ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলাম। 

এই ছিল শিশুদের প্রতি নবীপ্রেম। শুধু তাই নয় নবীজী নামাজে সেজদা অবস্থায় নাতি হাসান-হোসেন তার পিঠে চড়ে বসতেন যতক্ষণ তারা পিঠ থেকে না নামতে ততক্ষণ সেজদা থেকে উঠতেন না।