মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ; যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ইসলামী চিন্তা-চেতনার অত্যধিক প্রভাব আর প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দমালার ব্যবহার ছিল ফররুখ রচনাবলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯ অক্টোবর কবির ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী।
তিনি নিজ সাহিত্যকর্মে মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা ও ইসলামী চিন্তা-চেতনার বাহক হলেও তাঁর কাব্যকৌশল, শব্দচয়ন ও বাক্যশৈলী ছিল অনন্য বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আরবি, ফারসি ও আধুনিক বাংলার বহুমাত্রিক ব্যবহারে প্রণীত অনবদ্ধ রচনাশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ফররুখ আহমদকে মূল্যায়ন করেছেন। কেউ ‘ইসলামী রেনেসাঁর কবি’ আবার কেউ ‘মুসলিম নবজাগরণের কবি’ কেউ ‘মানবতাবাদী কবি’ শিরোনামে চিত্রায়িত করেছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি দৃঢ়ভাবে ইসলামী আদর্শের অনুসারী ছিলেন। এ কারণেই তিনি মুসলিম জাতির নবজাগরণ প্রত্যাশা করেছেন এবং ইসলামী মূল্যবোধ থেকেই তিনি মানবতাবাদের প্রেরণা লাভ করেছেন।
যার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর রচনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শব্দের পরতে পরতে গেথেছেন মুসলিমদের জাগরণের আহ্বান। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’তে প্রকাশিত ‘পাঞ্জেরী’ কবিতার কয়েকটি লাইন—
‘রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো উঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে,
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।’
মুসলিম জাতি যখন আপন ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি ভুলে এক অজানা পথে ধাবমান, অন্ধকারে নিমজ্জমান সেই জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে মঞ্জিলে পৌঁছানোর প্রতীক এই ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা। বাঙালি মুসলিমদের প্রাণের স্পন্দন এই কবির জন্ম ১০ জুন ১৯১৮ সালে বর্তমান মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা সৈয়দ হাতেম আলী এবং মাতা বেগম রওশন আখতার। তাঁরা উভয়েই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও একনিষ্ঠ মুসলিম।
প্রিয় কবির বাল্যকালে মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায়ই ফারসি সাহিত্য শেখার মাধ্যমে শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল। পরে কলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। তারপর খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষা না দিয়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।
কবির বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও রাজনৈতিক তৎপরতা আমাদের আলোচ্য বিষয় না হওয়ায় সেদিকে যাচ্ছি না। আমরা শুধু ফররুখ রচনাবলির ইসলামিক প্রভাব নিয়ে কথা বলতে চাই। মূলত ফররুখ আহমদের কাব্য প্রতিভা সর্বজন সমাদৃত পাওয়া শুরু করেছে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামী আদর্শ অবলম্বনকে কেন্দ্র করেই। তিনি বিপ্লবী দামামা বাজিয়েছেন কাব্যভাষায়। ফররুখ ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী লেখক। মুসলিম ঐতিহ্য ও চেতনাকে উজ্জীবিত করার জন্য তিনি তাঁর রচনায় মরুচারিতা, সমুদ্রাভিযান ও আরব্য আবহ তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
কাব্যক্ষেত্রে ফররুখ আহমদের যখন আবির্ভাব, তখন নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। জসীমউদ্দীন ও সমকালীন অন্য কবিদের তখন প্রবল দাপট। তার মধ্যেও ফররুখ আহমদ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। কাব্যের বৈচিত্র্যতা, শিল্পনৈপুণ্য আর রূপক উপমার অভিনব ব্যবহারে নিজস্ব এক কাব্যভাষা নির্মাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই কবিকে এই সাফল্য এনে দিয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের শিল্প বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কাব্যের শিল্প বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়ে কাব্যচর্চা চালিয়েছেন।
কবির অন্যতম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ (ডিসেম্বর, ১৯৪৪), ‘সিরাজাম মুনীরা’ (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (জুন, ১৯৬১) ইত্যাদি। কবি তাঁর কীর্তিমান সাহিত্যকর্মের জন্য ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরম্যান্স, ১৯৬৬ সালে আদমজী পুরস্কার ও ইউনেসকো পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদকসহ ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত হন।
অবশেষে ১৯৭৩ সালের ১৯ অক্টোবর শনিবার রমজান মাসে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মরহুম কবি চিরনিদ্রায় শায়িত হন শাহজাহানপুরের মসজিদসংলগ্ন আমবাগানে।