Islamic News BD - The Lesson of Peace
মুসলিম সভ্যতায় পারস্যের প্রভাব
রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ০১:১৮ পূর্বাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

ইসলামী সভ্যতার মূল ভিত্তি রচিত হয়েছে ইসলামের মূলনীতি অবলম্বনে। প্রধানত তা আরব সভ্যতার ওপর নির্ভর করলেও কালক্রমে ইসলামী সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও সভ্যতা দ্বারা। পারস্য সভ্যতাও ইসলামী সভ্যতাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তাকে সমৃদ্ধ করেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে পারস্য তার ভাষা, শিল্প ও স্থাপত্যের মাধ্যমে ইসলামের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ ও তা প্রসারে ভূমিকা রাখে। আরবরা যখন ইসলাম নামক ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, পারস্যবাসী তাকে সজ্জিত করেছিল এবং আধ্যাত্মিকতার অলংকারে পরিয়েছিল। এই অর্জনের প্রাথমিক মাধ্যম ছিল ফারসি ভাষা। কেননা ফারসি ছিল পারস্য (বর্তমান ইরান), তুর্কি, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান ও ভারতীয় উপমহাদেশের দাপ্তরিক ভাষা, জ্ঞান ও সাহিত্য চর্চার অন্যতম মাধ্যম। প্রকৃতপক্ষে পারস্য ছিল তাসাউফের ঝরনাধারা, যা থেকে তৃপ্ত হয়েছে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। 

ভৌগোলিকভাবে পারস্য এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। মধ্যযুগে বিশ্বের প্রধান প্রধান বাণিজ্য পথগুলো পারস্যকে অতিক্রম করেছিল। যার কয়েকটি মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া ও সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে শুরু হয়েছিল। উত্তর দিকের বাণিজ্য পথগুলো পারস্যের তিবরিজ শহরকে মধ্য এশিয়ার সমরকান্দ ও বুখারার সঙ্গে যুক্ত করেছিল।

যে পথগুলো সিল্ক পথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীনে প্রবেশ করেছিল। দক্ষিণের বাণিজ্য পথগুলো ইরানের ইস্পাহান থেকে আফগানিস্তানের কাবুল হয়ে হিন্দুকুশের গিরিপথ হয়ে গঙ্গাবিধৌত অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল। এসব পথে কেবল পণ্য বিনিময় হতো না, বরং বহু জ্ঞানী-গুণীরও চলাচল ছিল তাতে। হতো জ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের বিনিময়।

কাদেসিয়ার যুদ্ধের বিজয় মুসলিম বাহিনীকে পারস্যের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে দেয়।নাহাওয়ান্দের বিজয় জয়যাত্রাকে আরো শক্তিশালী করে। সর্বশেষ ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে তালাস যুদ্ধে চীনাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু থেকে আমু দরিয়ার মধ্যবর্তী সমগ্র পারস্য সামাজ্য মুসলিম খিলাফতের অধীনে চলে আসে। অবশ্য মহানবী (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে কয়েকজন পারস্যের ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সালমান ফারসি (রা.) ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ও বিখ্যাত।

উমাইয়া শাসনের প্রথম ৪০ বছর পারস্যে ইসলামের অগ্রগতি ছিল খুবই ধীর। আরবরা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের শর্তে পারসিকদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার সুযোগ দিয়েছিল। তবে তারা পারস্যের ইসলাম গ্রহণকারীদের ‘মাওয়ালি’ বলে আখ্যা দিত। যাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল আরবদের নিচে। খলিফা ওমর ইবনুল আবদুল আজিজ (রহ.) মাওয়ালিদের সমান সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে তিনি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয়দের উত্থান ঘটলে পারস্যবাসী তাদের সমর্থন দেয়। পারস্যের সেনাপতি আবু মুসলিম আব্বাসীয়দের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

আব্বাসীয় খলিফারা বরাবরই পারস্যের প্রশাসনিক নিয়ম-নীতি ও সামরিক কৌশলে মুগ্ধ ছিলেন। পারস্যের সমর কৌশল আব্বাসীয় বাহিনীর বিন্যাসই পাল্টে দেয়। পারসিক সেনাপতিরাও এই বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যেমন খলিফা মামুনের আমলে প্রভাবশালী সেনানায়ক ছিলেন সেনাপতি তাহির। খলিফা তাঁকে দক্ষিণ ইরাকের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন।

পারস্য প্রাচীন সভ্যতার ধারক ছিল, যাতে চীনা ও ভারতীয় সভ্যতার মিশ্রণ ছিল। ফলে পারস্যবাসী মুসলিম সমাজে উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও প্রশাসন পরিচালনা কৌশল সংযুক্ত করেছিল। মুসলিমরা তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতি দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। যেমন—আরবের সম্মিলিত বাহিনীকে প্রতিহত করতে সালমান ফারসি (রা.) নবীজি (সা.)-কে পরিখা খননের পরামর্শ দেন, যা অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। মুসলিম শাসকরাও পারস্যের শিল্প-সাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে পারস্যের কার্পেটশিল্প স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরাও পৃষ্ঠপোষকতার ধারা অব্যাহত রাখেন। উমাইয়া খলিফারা পারস্য ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্যরীতিতে জেরুজালেমের ডোম অব দ্য রক নির্মাণ করেন। পানির কৃত্রিম ধারা তৈরিতেও তাঁরা পারস্যের কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন।

নওমুসলিম পারস্যবাসী অল্প দিনের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে অবদান রাখতে শুরু করে। পারস্য অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী আরবদের সঙ্গে তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আরব ও পারসিক উভয়ই সম্প্রদায় নিজেদের ভেতর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরিতে সচেষ্ট হয়। আর তা সম্ভব হয়েছিল ধর্মীয় জ্ঞানচর্চায় তাদের সহযাত্রায়। কুফা অবস্থান ছিল আরবি ও ফারসি ভাষী অঞ্চলের মধ্যভাগে। এই শহরে বহু ইসলামী পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। যাঁদের অন্যতম ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। তিনি ফিকহশাস্ত্রের অন্যতম রূপকার এবং হানাফি মাজহাবের প্রাণপুরুষ।

খ্রিস্টীয় দশম শতকের শুরুতে দজলা নদীর পূর্ব তীরে পারসিকদের সংখ্যা আরবদের ছাড়িয়ে যায়। ফলে তারা মুসলিম বিশ্বের রাজনীতি, ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সেনাপতি তাহিরের বংশধররা নিশাপুরকে রাজধানী করে একটি নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। যারা মুসা আল খাওয়ারিজমির মতো গণিতবিদ এবং ইমাম তাবারি (রহ.)-এর মতো তাফসিরবিদকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। আরবের মতো পারস্যও ফিকহ ও হাদিস শাস্ত্রের উন্নয়নে অবদান রাখে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদ ইমাম বুখারি (রহ.) খোরাসানে বসবাস করতেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজি, ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-ও পারস্যের অধিবাসী ছিলেন।

পারস্যের সামানি (সুন্নি মুসলিম) শাসকরা পারস্যের ভাষা-সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যশিল্পের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমরকান্দ, বুখারা, নিশাপুর, মাশাদ ও হেরাত সুন্দরতম নগরী ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আল ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়। সামানিদের পর গজনভিরাও জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখে। যুগশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ আল বেরুনি মাহমুদ গজনভির দরবারের পণ্ডিত ছিলেন। মাহমুদ গজনভির পৃষ্ঠপোষকতায় মহাকবি ফেরদাউস মহাকাব্য ‘শাহনামা’ লেখেন। পারস্যের সেলজুক শাসকরাও ছিলেন জ্ঞানের সেবক ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা বাগদাদের ইসলামী খিলাফতের পতন ঠেকাতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। সেলজুক প্রধানমন্ত্রী নিজামুদ্দিন তুসি আবাসিক মাদরাসা ব্যবস্থার উদ্ভাবক।

ফারসি ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি ও সুফি জালালুদ্দিন রুমি (রহ.)-এর জন্ম হয়েছিল প্রাচীন পারস্য ও আধুনিক আফগানিস্তানের বলখ শহরে। তাঁর শিক্ষক ও পীর শামসুদ্দিন তাবরিজি (রহ.)-ও ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। মাওলানা রুমি (রহ.) রচিত মাসনভি, যাতে ২৭ হাজার পঙক্তি রয়েছে, এটি বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোর একটি। তাঁর ভাবশিষ্যদের মধ্যে কবি হাফিজ ও মাওলানা জামি (রহ.) বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁরাও ছিলেন পারস্যের সন্তান।

মধ্য এশিয়া থেকে বাগদাদ পর্যন্ত মোঙ্গলীয়দের প্রলয় তাণ্ডব মুসলিমের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস পাল্টে দিয়েছিল। তবে তা বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে পারস্যের ইসলামী ধারাকে এগিয়ে দিয়েছিল। চেঙ্গিস খান প্রধানত নগরগুলো ধ্বংস করেছিল। আর নগর ছিল আরবিভাষী অভিজাত আরবদের আবাসস্থল। তখন মুসলিমরা গ্রামমুখী হয়, যা ছিল প্রধানত ফারসিভাষীদের স্থান। পারস্যের গ্রাম ও কুঁড়েঘর থেকে ইসলাম বিজয়ীদের (মোঙ্গলীয়দের) পরাজিত করতে এবং বিশ্বময় আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দিতে নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সহস্রাব্দে ইমাম গাজালি (রহ.) ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী জ্ঞান সংস্কারক। তিনি ইরানের তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম গাজালি (রহ.) তাসাউফকে ইসলামী জ্ঞানের মূলধারায় যুক্ত করেন। তিনি কালামশাস্ত্রে (ধর্মতত্ত্ব) সংস্কার আনেন এবং দর্শনশাস্ত্রের প্রচলিত কাঠামো ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। শায়খ আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)-কে এ যাবৎকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী সুফি সাধক মনে করা হয়। তিনি ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর পারস্যের জিলানে জন্মগ্রহণ করেন। তাসাউফের উচ্চতর মর্যাদার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞানে ছিল তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য। সুফি ধারায় রাজত্বকারী পারস্যের আরো কয়েকজন কৃতি সন্তান হলেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, মাওলানা রুমি, শায়খ বাহাউদ্দিন নকশাবন্দি, শায়খ শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দি (রহ.)।

১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলীয় শাসক ইলখানিত গাজান ইসলাম গ্রহণ করলে পারস্য অঞ্চলে ইসলামের নব জোয়ার সৃষ্টি হয়। পারস্যের মূল ভূমি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের কোনায় কোনায় ইসলামের বার্তা পৌঁছে যায় তাদের মাধ্যমে। পারস্যের মুসলিমরাই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম স্থাপত্যগুলো সুফিবাদ ও পারস্যের স্থাপত্যরীতি দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। পারস্যরীতির সঙ্গে স্থানীয় রীতি ও ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল মোগল স্থাপত্যরীতি। তাজমহল, লালকেল্লা, ফতেহপুর সিকরি ইন্দো-পারসিয়ান স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন। পারস্যের মুসলিমদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো জাভিয়া।

জাভিয়া হলো একটি ধর্মীয় কমপ্লেক্স। যাতে মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত থাকে। উত্তর আফ্রিকা ও তুরস্কের শাসকরা জাভিয়া প্রতিষ্ঠায় নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ভারতীয় উপমহাদেশেও জাভিয়ার আদলে একাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। যেমন—ইলতুিমশ প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা কমপ্লেক্স। বাংলাদেশের দারসবাড়ি মাদরাসাও অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়।