সুফিবাদ হলো এক প্রকার ইসলামী আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই তত্ত্বের মর্ম কথা। সর্বক্ষণ সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে তাঁর সানিধ্য অর্জনই সুফিবাদের প্রকৃত লক্ষ্য। এই বিশাল বাংলায় সুফিবাদের সগৌরব উপস্থিতি দীর্ঘকালের। কখনো প্রকাশ্য, কখনো প্রচ্ছন্ন, কখনো প্রগলভ, কখনো আবার প্রতীকে-প্রত্যয়ে মরমি ভাবধারার বাউল কবির কণ্ঠে, সাঁইজির আখড়ায় আপাত শ্রুত বলে মনে হলেও সেই প্রাচীন উপনিষদকালেও তাদের ধ্যান ও দর্শনের মধ্যে সুফিতত্ত্বের যোগসূত্রের সন্ধান মিলবে। ভলগা থেকে গঙ্গায় যে স্রোতধারা শতসহস্র বছরের বহমান, তার মধ্যে যাতায়াত ঘটেছে এই দর্শন আচারী আবহের। সুফি সাধক মাওলানা জালালউদ্দিন রুমীর অমীয় বাণী বাংলার পথে-প্রান্তরে চারণ কবির কণ্ঠেই কেবল নয় নিভৃতচারী সাধক, কর্মবীর আর মুখরিত মানুষের মুখে মুখেও ফিরেছে। আমাদের জীবনমানে, ধ্যান-জ্ঞানে, প্রত্যয় ও প্রত্যাশায়, চাওয়া-পাওয়ার মাঝে মরমি ধ্যান-ধারণার বলিষ্ঠ উপস্থিতি রয়েছে যা হয়তো এক কথায় বলে শেষ করা যাবে না।
বাংলাদেশের সুফি চর্চার বহু পুরোধা ছিলেন যারা নিজেদের আজীবন সুফি সাধনায় আত্মনিয়োজিত রেখেছেন। তবে কেবলই মরমি চর্চায় নিজেদের আধ্যাত্মিকতা, অধ্যয়ন, অধ্যবসায়, আচার-আনুষ্ঠানিকতা সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং সুফি চর্চার ছোঁয়ায় অগণিত রচনাবলির দ্বারা বাংলা শিল্প-সাহিত্যকে করেছেন আরও সমৃদ্ধ! সুফি সাধনা মূলত মুক্তবুদ্ধির সত্যিকারের জাগরণ ঘটায়। ধর্মের সহিত কর্মের সংযোগ-সমন্বয় সাধন করে জীবনকে করে তোলে অর্থবহ এবং সর্বোপরি তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রকারান্তরে এই আদর্শ মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামি রহিত করে মানবিক মূল্যবোধের আদর্শে উজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। আর এসব কিছুর মিশেলই হলো সুফি সাধনার অন্তর্নিহিত বাণী। প্রকৃতপক্ষে ঠিক এ কারণেই সুফি সাধকরা যুগে যুগে মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবেই আখ্যায়িত ছিলেন। তারা সার্বিক সাংস্কৃতিক বিকাশ ও সম্প্রদায়গত বিভেদ-বিভাজন রহিত উদার, উন্মুক্ত মনোভাব-মনোভঙ্গির বিকাশকেই প্রাধান্য দিয়ে গেছেন।
ধর্ম আর কর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনই সুফিবাদের সার কথা। আমরা জানি, চিন্তা থেকেই কাজের উৎপত্তি ঘটে। যেরূপ ভাবনা সেরূপই তার বাস্তবায়ন। আমাদের মনে বাস করেন এক কর্মবিধায়ক আর যার আবাস-অবগাহনের সুতা গাঁথা থাকে আরেক সূত্রে। ভাববাদীরা যাকে বলে আদিবাস কিংবা আরশে মহল্লা, সেখানে সে থাকে প্রভু নিরঞ্জনের নিরন্তর তত্ত্বাবধানে। আর এদিকে তার ছায়া ‘(মানবদেহ) খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ হয়ে বারবার আসা-যাওয়া করে। তার পায়ে বেড়ি পরাবার চেষ্টা করা হলেও তাকে বাঁধা যায় না। কেননা তার মূল সুখ বাঁধা আছে আরশে মহল্লায়। তার প্রতিফলন ঘটে আট কুঠুরি নয় দরজার মধ্যে, অচিন এই পাখিটির পিঞ্জরায়। বাঁশির সুর শুনে সে কেবলই ছটফট করে। নিত্য যোগাযোগ হয় তার সাথে। কিন্তু সেই যোগাযোগের অবকাঠামো অনুধাবনে সবার জ্ঞান সমান হয় না। বস্তুত, আয়নায় ধুলার আস্তর পড়লে প্রতিবিম্ব কখনোই পরিষ্কার ফুটে ওঠে না। মরমি সাধকরা তাদের মনের আয়না পরিষ্কার রাখতে সদা তৎপর থাকেন। আর বাকি দশজনের চেয়ে তাদের যোগাযোগের জ্যোতি ও ক্ষমতা অনেক বেশি গতিময়। বাংলাদেশের মানুষ আবহমান কাল থেকেই ধর্মভীরু। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই এতদঞ্চলে খ্যাতিমান ওলি-আউলিয়া, সুফি সাধকদের অবিরাম প্রচারের দরুন ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছে। নির্মোহ, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, নিরহঙ্কারী আর অন্যের জন্য সবসময় নিবেদিত ও সৃষ্টির সেবায় জীবন উৎসর্গকারী এসব মহান সুফি, পীর ও দরবেশদের পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও সহজ-সরল জীবনযাপন মানুষকে শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রতি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও আকর্ষণ করেছে। তাদের এরূপ অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য, ব্যক্তিত্বের জাদুময়িতাই এই দেশে ইসলামের ভিতকে আরও সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করেছে। আর তাদের প্রভাবেই ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে বাস্তব জীবনে প্রেমময় ইসলামের সুফিবাদী ভাবধারাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদয়ে লালন-পালন করে আসছে।
সুফি সাধকরা বেছে নেন নিরলস সুফিতাত্ত্বিক গবেষণা, মসনবী চর্চা ও সুফি দর্শনের আলোকে মানবচিত্তে শান্তির খোরাক বিতরণের পথকে। আর তা করতে গিয়েই তাঁরা সুফিতত্ত্বের গভীরে প্রবিষ্ট হন, কুড়িয়ে আনেন অমূল্য সব রতœরাজি! তারাই সর্বতোভাবে উদার ধর্মবোধে বিশ্বাসী ও সাম্প্রদায়িকতা রহিত মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। সুফিবাদী সাধকরা ধর্মকে শান্তির উৎস হিসেবে দেখেন এবং সকলের কাছে তুলেও ধরেন। তাদের আধ্যাত্মবাদ জনসাধারণকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাদের ভাবধারায় সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা মানবজাতির জন্য এক নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনা বয়ে আনে।