সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা মহান রাব্বুল আলামিনের পর একজন মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি ইহসান ও অনুগ্রহ থাকে তার বাবা-মায়ের। মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, জন্মদান করেন, স্তন্যদান করেন, কোলে-পিঠে বড় করেন। বাবা দিনরাত পরিশ্রম করে তার ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করেন। তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করতে সচেষ্ট থাকেন।
বাবা-মায়ের অপরিসীম অনুগ্রহের ঋণ শোধ করার সামর্থ্য কোনো সন্তানের নেই। পৃথিবীতে সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি নিঃস্বার্থ কল্যাণকামীও আর কেউ নেই। তাই সন্তানের কর্তব্য বাবা-মায়ের নেক নির্দেশ মেনে চলা, তাদের খুশি ও সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা, তারা বার্ধক্য ও অসুস্থতায় অসহায় হয়ে গেলে তাদের দেখাশোনা করা, সেবা করা, কোনোভাবেই তাদের কষ্ট না দেওয়া।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং বাবা-মায়ের সাথে সদচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের উফ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। তাদের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন । (সুরা ইসরা: ২৩, ২৪)
বাবা-মা মৃত্যু বরণ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব বা কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। এখানে আমরা মৃত্যুর পর বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি কর্তব্যের ব্যাপারে আলোচনা করছি:
কোরআনে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন কীভাবে হবে তা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের আগে ঋণ পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন। মৃতের কোনো অসিয়ত থাকলে তা পালন করার আগে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। (দেখুন সুরা নিসা: ১১-১৪)
আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার সাহাবিদের জানাজা নামাজ পড়াতেন না, যদি তার ঋণ অপরিশোধিত থাকত। (সহিহ বুখারি: ২১৪৮)
তাই কারো মৃত্যু হলে কাফন-দাফনের পর তার সম্পত্তি বণ্টনের আগেই সন্তানদের কর্তব্য হলো, বাবা-মায়ের ঋণ থাকলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে আগে তা আদায় করা। এরপর তাদের কোনো অসিয়ত থাকলে ঋণ আদায়ের পর অবশিষ্ট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে তা পূরণ করা। ঋণ আদায় ও এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে অসিয়ত পূরণের পর অবশিষ্ট সম্পদ নির্দিষ্ট হারে ওয়ারিশদের মাঝে বণ্টন করতে হয়।
বাবা-মায়ের যদি সম্পদ না থাকে তাহলে নিজের সম্পদ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা তার সন্তানদের ওপর ওয়াজিব নয়। কিন্তু বাবা-মায়ের প্রতি সদাচারের অংশ হিসেবে তাদের আত্মার শান্তির জন্য সন্তানের উচিত সাধ্য থাকলে ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া। আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি অহংকার, গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ ও ঋণ-এই তিন বিষয় থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুনানে তিরমিজি, সুনানে ইবনে মাজাহ)
মৃত বাবা-মায়ের কোনো গুনাহের কাফফারা বা আমলের ফিদিয়া আদায় যদি বাকি থেকে থাকে, তাহলে সন্তানের কর্তব্য তাদের সম্পদ থেকে বা সাধ্য থাকলে নিজের সম্পদ থেকে সেগুলো আদায় করে দেওয়া। যেমন কেউ যদি জীবনকালে শপথ, রোজা ভঙ্গ করে থাকে এবং কাফফারা আদায় করার সুযোগ না পায়, তাহলে সদকার মাধ্যমে সেগুলোর কাফফারা আদায় করে দেওয়া উচিত। রোজার ফিদিয়া আদায় বাকি থাকলে তা আদায় করে দেওয়া উচিত।
উল্লেখ্য যে, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাজা রোজা রাখা বা কাজা নামাজ আদায়ের নিয়ম নেই। রোজা বা নামাজের কাজা আদায় করার আগেই যদি কারো মৃত্যু হয়ে যায়, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয় স্বজনের জানা থাকে, তাহলে তারা তার পক্ষ থেকে নামাজ পড়ে বা রোজা রেখে তার কাজা আদায় করার সুযোগ থাকে না।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে (রা.) অন্যের পক্ষ থেকে রোজা রাখা বা নামাজ আদায় করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, কেউ অন্যের পক্ষ থেকে রোজা রাখবে না এবং অন্যের পক্ষ থেকে নামাজ পড়বে না। (মুআত্তা ইমাম মালেক: ৯৪)
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বাবা মায়ের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ওপরে উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তআলা বলেন, বল, হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন । (সুরা ইসরা: ২৪)
বাবা-মায়ের জীবনকালেও তাদের সুস্থতা ও নেক হায়াতের জন্য দোয়া করতে হবে। মৃত্যুর পর তাদের ক্ষমা, আখেরাতের মুক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।
সন্তানের দোয়া যে বাবা-মায়ের কাজে লাগে, তাদের গুনাহ ক্ষমা করা হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় তা আল্লাহর রাসুলের (সা.) হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি। রাসুল (সা.) বলেন, কোনো কোনো ব্যক্তি জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ করে বলবে আমার এত মর্যাদার অধিকারী কীভাবে হলাম? তাকে বলা হবে, তোমার জন্য তোমার সন্তানের দোয়া ও ইস্তেগফারের কারণে তুমি এত মর্যাদা পেয়েছ। (সুনানে ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমদ)
আরেকটি বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেন, আদম সন্তান যখন মারা যায়, তখন তার তিন প্রকার আমল ছাড়া অন্য সব আমলের ধারা বন্ধ হয়ে যায়; ১. সদকায়ে জারিয়া (ফায়েদা অব্যাহত থাকে এ রকম সদকা যেমন মসজিদ নির্মাণ করা, কূপ খনন করে দেওয়া ইত্যাদি) ২. ইলম বা জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে ৩. নেক সন্তান যে তার জন্য নেক দোয়া করতে থাকে। (সহিহ মুসলিম)
মৃত্যুর পর বাবা-মায়ের কাছে সওয়াব পৌঁছানোর নিয়তে তাদের পক্ষ থেকে সামর্থ অনুযায়ী দান-সদকা করা উচিত। সন্তানের সদকার সওয়াব বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে। সাহাবিরা মৃত বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে সদকা করতেন বলে বর্ণিত রয়েছে।
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, সাদ ইবনে উবাদার (রা.) অনুপস্থিতিতে তার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি আল্লাহর রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞাসা করলেন, আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার কোনো উপকারে আসবে? নবিজি (সা.) বললেন, হ্যাঁ। সাদ (রা.) বললেন, আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি আমার মিখরাফ নামের বাগানটি আমার মায়ের জন্য সদকা করে দিলাম। (সহিহ বুখারি)