Islamic News BD - The Lesson of Peace
রোজা মানবদেহে তারুণ্য ও রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়
রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:১৩ অপরাহ্ন
Islamic News BD - The Lesson of Peace

Islamic News BD - The Lesson of Peace

রোজা একটি শারীরিক ইবাদত এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। এর ইহকালীন ও পরকালীন উপকারিতা অপরিসীম। কারণ রোজাদারদের মহান আল্লাহ বিশেষ সংবর্ধনা দেবেন। বিশেষ পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন। আবার শারীরিক সুস্থতার জন্যও রোজা অনেক উপকারী। দেশে-বিদেশে রোজার স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে।

রোজা নিয়ে গবেষণাকারীদের একজন ডা. মুহাম্মদ গোলাম মুয়াযযাম তাঁর বই স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ইসলাম-এ রোজার স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন, ‘প্রত্যেক সাবালক নারী-পুরুষ মুসলমানের জন্য বছরে এক মাস (রমজান মাসে) রোজা রাখা ফরজ। কোরআনে বলা হয়েছে, সব জাতির জন্যই সিয়াম ছিল তবে একমাত্র মুসলমান জাতিই রমজান মাসে রোজা পালন করে থাকে। রোজা প্রকৃতপক্ষে উপবাস নয় বরং খাদ্য গ্রহণের সময়ের পরিবর্তন মাত্র। অমুসলিম এবং কোনো কোনো দুর্বল মুসলমান রোজায় শরীরের ক্ষতি হয় বলে সন্দেহ করে। এই সন্দেহ দূর করার জন্য ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত রমজান মাসে ঢাকা ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে রোজার বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা চালিয়েছি আমার কয়েকজন সহযোগীর সাহায্যে। এই গবেষণার ভিত্তিতে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছি। এই সব গবেষণায় সুস্থ শরীরে রোজার কোনো ক্ষতি তো হয়ই না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপকার লক্ষ করা গেছে। রোজার স্বাস্থ্যগত দিকগুলো নিম্নরূপ :

(ক) সুস্থ রোজাদারদের মধ্যে কোনো প্রকার ক্ষতির লক্ষণ পাওয়া যায়নি। রক্ত চাপ, BMR, ECG, Blood Biochemistry-সহ সব রকম পরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক পাওয়া গেছে।

(খ) শতকরা প্রায় ৮০ জনের শরীরের ওজন কিছু কমেছে। এই ওজন হ্রাসের পরিমাণ এক মাসে এক থেকে দশ পাউন্ড পর্যন্ত কিন্তু কোনো রোজাদার এতে দুর্বলতার অভিযোগ করেননি। বরং বেশি ওজনের লোকদের অনেকে ওজন হ্রাসে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রায় ১২ শতাংশ রোজাদারের ওজন এক থেকে চার পাউন্ড পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাকি ৮ শতাংশ রোজাদারের ওজন স্থির থাকে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শরীরের অতিরিক্ত ওজন (obesity) হ্রাসের জন্য নানারূপ চিকিৎসাপদ্ধতি চালু রয়েছে, যার সবকয়টিই কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ। রোজায় খুব ধীরে অল্প অল্প করে ওজন হ্রাস পায় তাই ড়নবংব রোগীরা নফল রোজার মাধ্যমে সহজেই ওজন হ্রাস করতে পারে। 

(গ) পাকস্থলীর অম্লরসের ওপর প্রভাব (Effect on Gastric Acidity) শতকরা প্রায় ৮০ জন রোজাদারের বেলায় গ্যাস্ট্রিক এসিড স্বাভাবিক পাওয়া গেছে। প্রায় ৩৬ শতাংশ অস্বাভাবিক এসিডিটি স্বাভাবিক (Normal) হয়েছে, যা এসিড বেশি (Hyperacidity) বা কমা (Hypoacidity) উভয় অবস্থায়ই দেখা গেছে। প্রায় ১২ শতাংশ রোজাদারের এসিড একটু বেড়েছে তবে কারো ক্ষতিকর পর্যায়ে যায়নি। সুতরাং রোজায় পেপটিক আলসার হতে পারে এমন ধারণা ভুল এবং মিথ্যা। তা ছাড়া পেট খালি থাকলে অম্লরস হ্রাস পায় আর পেপটিক আলসারে অম্লরস বৃদ্ধি পায়।

অবশ্য যদি কারো ক্ষতিকর আলসার থাকে এবং ক্ষুধা হলে ব্যথা বৃদ্ধি পায় তাহলে জোর করে রোজা রাখার প্রয়োজন নেই। কারণ আল্লাহ বলেন, যে অসুস্থ অথবা ভ্রমণকারী সে রোজা না রেখে পরে কাজা করে নেবে...। (সুরা : আল বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

যে রোগে রোজা রাখা সম্ভব নয় এবং সফরে রোজা রাখা কষ্টকর হলে সে সময় রোজা না রেখে পরে সুস্থ হয়ে বা বাড়ি ফিরে যে কয়দিন রোজা ভেঙেছে সে কয়টি রোজার কাজা আদায় করতে হবে। এই আইনও স্বাস্থ্যনীতিভিত্তিক।

(ঘ) রোজার সাহরি, তাড়াতাড়ি ইফতার করা এবং পেট ভরে খেয়ে দীর্ঘ তারাবির নামাজ সবই স্বাস্থ্য রক্ষামূলক।

(ঙ) রোজার হুকুম-আহকাম যে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানসম্মত তার আরো উদাহরণ :

(১) নাবালক হলে রোজা ফরজ নয়। কারণ দীর্ঘ উপবাসে শিশুদের স্বাস্থ্যহানি হতে পারে।

(২) ঋতুমতী নারী ও সন্তান প্রসবের পর স্রাবকালে রোজা রাখা নিষিদ্ধ। এ সময় প্রচুর রক্তক্ষরণে শরীর দুর্বল থাকে।

(৩) গর্ভবতী নারীর সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে এবং দুগ্ধবতী মায়ের বুকের দুধ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে রোজা ভাঙার অনুমতি আছে।

(৪) রোজা চান্দ্র বছর অনুযায়ী রাখতে হয় বলে রোজার মাস বিভিন্ন ঋতুতে পড়ে। এর ফলে যেকোনো দেশে ভালো-মন্দ, শীত-গ্রীষ্ম এবং ছোট ও লম্বা দিন সব অবস্থায় রোজা রাখার সুযোগ হয়। সৌর মাস অনুসরণ করলে কোনো দেশে জীবনভর কঠিন গরম বা শীতে রোজা রাখতে হতো। সুতরাং এটা একদিকে বিশ্বজনীন আরেক দিকে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানভিত্তিক।

এ ছাড়া ডা. তাসনিম জারা নামের একজন গবেষক ২০২২ সালে তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে ‘রোজার অসাধারণ সাতটি উপকার’ শীর্ষক আলোচনা করেছেন। সেখানে আছে—

তারুণ্য ধরে রাখা : রোজা মানবদেহে তারুণ্য ও রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। জাপানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তা হলো, মানুষের সারা শরীর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে গঠিত। এই কোষগুলো কিছুটা কারখানার মতো। এখানে সারা দিন কাজ চলছে, কিছু আবর্জনা তৈরি হচ্ছে, কিছু যন্ত্রপাতি ভেঙে যাচ্ছে, কিছু মেশিন নষ্ট হচ্ছে। সেগুলো মেরামতের প্রয়োজন হয়। এই কাজটা কোষ নিজেই করে অটোফিজি নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অকার্যকর ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো রিসাইকল করে তা আবার ব্যবহারের যোগ্য করে তোলে, কোষকে সতেজ হতে সাহায্য করে এবং শরীরে তারুণ্য ধরে রাখতে সহযোগিতা করে। এই প্রক্রিয়া যথাযথভাবে না হলে ব্রেনের বিভিন্ন রোগ যেমন আলঝেইমারস, যে রোগে বয়স্করা ভুলে যেতে থাকে, আবোলতাবোল বলে; পারকিনসন্সের মতো রোগগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে। মানুষ যদি সারাক্ষণ খাওয়ার মধ্যে থাকে, তখন অটোফেজি প্রক্রিয়া দমে থাকে। অন্যদিকে রোজা অবস্থায় অটোফেজি প্রক্রিয়া বেড়ে যায়। (প্রবন্ধ :  Autophagy in healthy aging and disease)

ওজন কমানো : বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের করা ৩৫টি গবেষণা একত্র করে দেখা গেছে, রমজানের রোজার পর গড়ে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে। এটা গড় হিসাব। অর্থাত্ কারো ওজন এর থেকে বেশি কমেছে, আবার কারো ওজন বেড়েছে। (প্রবন্ধ : Effects of ramadan and non-ramadan intermittent fasting on body composition: A systematic review and meta-analysis.) 

রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ : তুরস্কের গবেষকরা ইরান, মিসর, কুয়েতসহ আরো কয়েকটি দেশের করা ১৬টি গবেষণা একত্র করে দেখেছেন যে রোজা রাখার পর নারী-পুরুষ উভয়ের রক্তে সুগারের মাত্রা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।

আরেকটি আলাদা গবেষণায় ইন্দোনেশিয়ার গবেষকরা ২৮টি গবেষণা একত্র করে দেখেছেন, রমজানের রোজা রাখার ফলে ডায়াবেটিক রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খানিকটা উন্নতি হয়েছে। যারা ডায়াবেটিক রোগী তারা রোজা রাখা অবস্থায় আপনার ওষুধ কখন ও কিভাবে গ্রহণ করবেন, সেটা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারেন। (প্রবন্ধ : Time restricted eating for the prevention of type 2 diabetes)

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ : আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও বাহরাইনের গবেষকরা ৯১টি গবেষণা একত্র করে দেখেছেন, রমজানের রোজায় রক্তে কোলেস্টেরল আগের তুলনায় ভালো নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেরও তিনটি গবেষণা আছে। (প্রবন্ধ : Effect of Ramadan Fasting on Total cholesterol (TC) Low density lipoprotein cholesterol (LDL-C) and High density lipoprotein cholesterol (HDL-C) in Healthy Adult Male)

ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ : ভারত, পাকিস্তান, কাতারসহ অন্যান্য দেশের আরো ৩২টি গবেষণা একত্র করে দেখা গেছে রমজানের রোজায় ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আসে—ওজন না কমলেও। ইফতার ও সাহরিতে বেশি বেশি ফলমূল খেলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা আরো সহজ হবে। (প্রবন্ধ : Effect of Religious Fasting in Ramadan on Blood Pressure : Results From LORANS (London Ramadan Study) and a Meta Analysis)