আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর বুকে মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের দ্বারা অনেক উপায়-উপকরণ তৈরি করে রেখেছেন। যাতে মানুষ তাদের জীবন চলার পথকে সহজ করে নিতে পারে। নিজেদের কাজকর্ম সঠিক ও নির্ভুলভাবে পরিচালনা করতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম একটি উপায় বা মাধ্যম হলো, দিন সপ্তাহ মাস ও বছরের হিসাব।
পৃথিবীর শুরুর লগ্ন থেকেই দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস আর মাস পেরিয়ে বছর ইত্যাদি ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। পুব আকাশে বাঁকা চিকন সোনালি চাঁদ উঁকি দিয়ে জানান দিল নতুন বছরের শুভাগমন। শুরু হয়ে গেছে ৪৬তম হিজরি বর্ষ। অতিবাহিত হয়ে গেল আমাদের প্রত্যেকের জীবনের আরও একটি বছর। এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন আমাদের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই, যে এই সময়ের মূল্যায়ন করে। আর এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন।
আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই দিন-রাতের একের পর এক আগমনে এবং আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তাতে সেই সব লোকের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে, যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে।” (সুরা ইউনুস : ৬)।
বছরের প্রথম মাস হিজরি মাস হচ্ছে মহররম। যা পবিত্র কোরআনের ভাষায় সম্মানিত মাস। আল্লাহতায়ালা বছরের মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসকে সম্মানিত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মহররম মাস। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, “প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২টি, যা আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ (লওহে মাহফুজ) অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে, যেদিন আল্লাহ আকামণ্ডলি ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ, সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দীন (এর দাবি) সুতরাং এই মাসগুলোর ব্যাপারে নিজের প্রতি জুলুম করো না।” (সুরা তাওবা : ৩৬)।
সম্মানিত মাসগুলো চারটি। হাদিসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, “রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে। আসমান-জমিন সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলি যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ-সুবিধা ও মনমতো মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল) ১২ মাসে এক বছর। এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আরেকটি হলো রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।” (সহিহ বুখারি : ৪৬৬২)।
অন্য এক হাদিসে মহররম মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, “(রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহররম বলে থাক।” (সুনানে কুবরা- নাসাঈ : ৪২১৬)। এই মাসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যার দ্বারা এই মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায়। যেমন- এই মাসে বেশি বেশি ইবাদত করার কথা বলা হয়েছে।
হাদিসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, “রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামাজ)।” (সহিহ মুসলিম : ১১৬৩) অতএব এই মাসে ইবাদত-বন্দেগি ও রোজা রাখার ফজিলত রয়েছে। সুতরাং এর প্রতি যত্নবান হওয়া চাই। বিশেষ করে ১০ মহররম আশুরার রোজা।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালীন আশুরার রোজা রাখতেন এমনকি মক্কার কাফের মুশরিকরাও এই দিনকে সম্মান করত। হজরত আয়েশা রাজিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “জাহেলি যুগে কোরাইশরা আশুরার রোজা পালন করত এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ রোজা পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনো এ রোজা পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজা ছেড়ে দেওয়া হলো। যার ইচ্ছা সে রাখবে, আর যার ইচ্ছা রাখবে না।” (বুখারি : ২০০২; মুসলিম : ১১২৫)।
এই মাসের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম আরও একটি হচ্ছে, তাওবা-ইস্তিগফার। যা গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। সর্বদাই এর সঙ্গে জড়িত থাকতে হয়। অতএব এই মাসে তাওবা-ইস্তিগফার পূর্বের তুলনায় অধিক পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। বান্দা তার রবের সামনে নত হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, এতেই তো রয়েছে বন্দেগির বিরাট শান। বিশেষত এই মাস তাওবা কবুলের মাস।
এই মাসে অতীতের বহু জাতির তাওবা আল্লাহ কবুল করে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এক সাহাবি নবীজীর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! রমজানের পর আপনি কোন মাসে রোজা রাখতে বলেন? নবীজী বললেন, তুমি যদি রমজানের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রোজা রাখ। কেননা মহররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একদিন আছে, যেদিন আল্লাহতায়ালা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন।” (জামে তিরমিজি : ৭৪১)
অতএব, মহররমের এই বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ সময়কে কাজে লাগিয়ে এর পরিপূর্ণ ফায়দা হাসিল করতে হবে এবং এই মাসকে ঘিরে যত ধরনের কুসংস্কার ও বেদআতি কর্মকান্ড যা সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, তার থেকে বিরত থাকতে হবে। আলোচ্য প্রবন্ধে আমলের কথা যা বলা হয়েছে, এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।