সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ যেমন ন্যায়বিচারক তেমনি মানবজাতিকে তাদের জীবনের সবদিকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু ন্যায়বিচারের পরিচয় কী? ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা গুরুত্ব কতটুকু? ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুফল বা উপকারিতা কী? এ সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা কী?
ন্যায়বিচারের পরিচয় আরবি আদল শব্দের অর্থ হলো ন্যায়বিচার। তাই ন্যায়বিচার হলো- আদল, ইনসাফ করা, ভারসাম্য রক্ষা করা ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তে ন্যায়বিচার হলো- কোনো বস্তুকে সমান অংশের অধিকারীদের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করে দেওয়া, যাতে কারো অংশ বিন্দু পরিমাণও কম বা বেশি না হয়। অর্থাৎ যার যতটুকু প্রাপ্য আছে, তা আদায়ের জন্য সুব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার নাম ন্যায়বিচার । নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ন্যায়বিচারের গুরুত্ব মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, বিচার-ফয়সালা, লেন-দেন, ক্রয়-বিক্রয়, যুদ্ধ-সন্ধি, ভোগ-ব্যবহারে সততা, ন্যায়-নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার নামই ন্যায়বিচার। সুষ্ঠু সমাজ বিকাশে তথা ইনসাফ ও ন্যায়-নীতি ভিত্তিক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ন্যায়বিচারের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আদল বা ন্যায়বিচারই হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধ, সামাজিক শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। সমাজ সংরক্ষণ, শাসন পরিচালনা এবং পারস্পরিক সম্বন্ধ রক্ষা ও উন্নয়নের প্রতিটি প্রেক্ষাপটে- ন্যায়বিচারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুফল
১. ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা
যে সমাজে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন আছে সেখানে প্রতিটি মানুষের জান-মাল, মানসম্মান ও অধিকার নিরাপদ। কেউ অন্যায় বা অপরাধ করলে যদি উপযুক্ত বিচার-ফয়সালা করা হয়। ন্যায়বিচার করা হয়; কারো পক্ষপাতিত্ব করা না হয়; কেবল তখনই সে সমাজে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে। এ জন্য মহান আল্লাহ তাআলা এ মর্মে নির্দেশ দেন-
وَ اِذَا حَکَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡکُمُوۡا بِالۡعَدۡلِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ نِعِمَّا یَعِظُکُمۡ بِهٖ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا
আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে কতইনা সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সুরা নিসা : আয়াত ৫৮)
২. সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা
সমাজ জীবনে মানুষকে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরোধী তৎপরতা যেমন- চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ছিনতাই, খুন-খারাবি, হত্যা-লুণ্ঠন, জুলুম, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার-ব্যভিচার, শোষণ-নিপীড়ন ইত্যাদি কার্যকলাপ সমাজকে কলুষিত ও বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সব সামাজিক অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়; তবে সে সমাজে অন্যায় ও অপরাধ প্রবণতা সংক্রামক ব্যাধির মত বিস্তার লাভ করবে। ফলে সে সমাজের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সে সমাজ আর মানুষের বাসোপযোগী থাকে না। সুতরাং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা একান্ত অপরিহার্য।
৩. অধিকার প্রতিষ্ঠা
সমাজের শক্তিশালীরা যেন দুর্বলের ওপর অত্যাচার করতে না পারে; অন্যের সম্পদ যাতে জোরপূর্বক ভোগ-দখল করে নিতে না পারে; সবাই যেন পুর্ণ মর্যাদা ও মৌলিক অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সেজন্য সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন।
৪. ব্যবসা-বাণিজ্যে
মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও লেন-দেনে সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ন্যায়বিচারের গুরুত্ব সীমাহীন। দ্রব্য-সামগ্রীতে ভেজাল দেওয়া, ওজনে কম-বেশি করা, পণ্যের ত্রুটি গোপন করে বাজারজাত করা- এ সবই ব্যবসায়িক অসাধুতা সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-
وَ اَوۡفُوا الۡکَیۡلَ وَ الۡمِیۡزَانَ بِالۡقِسۡطِ ۚ
আর পরিমাপ ও ওজন ইনসাফের সঙ্গে পরিপূর্ণ দেবে।... (সুরা আনআম : আয়াত ১৫২)
৫. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার
সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থাকে মজবুত ও সুসংহত রাখতে অবশ্যই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। ন্যায়বিচার পরিপন্থী প্রশাসন ব্যবস্থা বেশি দিন টিকতে পারে না। একসময় প্রশাসনের প্রতি জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে প্রশাসনিক অবকাঠামো ভেঙে যায়। তাই প্রশাসনিক মজবুতী ও সুষ্ঠুতার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম।
৬. সাম্য প্রতিষ্ঠায় ন্যায়বিচার
সমাজের সকল কর্মকাণ্ড যদি ন্যায়বিচারের সঙ্গে হয়, তবে সমাজের প্রতিটি লোকের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরিত হয়। ন্যায়বিচার বা ন্যায়দণ্ডের ছায়াতলে সবাই ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে ন্যায়বিচারের অভাবে প্রতিহিংসা দানা বাঁধতে থাকে এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়। ফলে একটা সময় চরম পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এজন্যই মহান আল্লাহ বলেন-
اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُ بِالۡعَدۡلِ وَ الۡاِحۡسَانِ وَ اِیۡتَآیِٔ ذِی الۡقُرۡبٰی وَ یَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ وَ الۡبَغۡیِ ۚ یَعِظُکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও নিকট আত্মীয়দের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি আশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (সুরা নাহল : আয়াত ৯০)
৭. সাক্ষ্য ও বিচারকার্যে ন্যায়বিচার
আল্লাহর দেওয়া আইন (কোরআন) ও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী বিচারকার্যে এবং সাক্ষ্য প্রদানে শত্রু-মিত্র, বন্ধু-বান্ধব, নিকটাত্মীয়, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, আপন-পর, উঁচু-নিচু, ইতর-ভদ্র, জাতি-ধর্ম গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার প্রতিই সমান আচরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এ মর্মে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلّٰهِ وَ لَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ اَوِ الۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ ۚ اِنۡ یَّکُنۡ غَنِیًّا اَوۡ فَقِیۡرًا فَاللّٰهُ اَوۡلٰی بِهِمَا ۟ فَلَا تَتَّبِعُوا الۡهَوٰۤی اَنۡ تَعۡدِلُوۡا ۚ وَ اِنۡ تَلۡوٗۤا اَوۡ تُعۡرِضُوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا
;হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে। যদিও তা তোমাদের নিজদের কিংবা বাবা-মার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। যদি সে বিত্তশালী হয় কিংবা দরিদ্র, তবে আল্লাহ উভয়ের ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা এড়িয়ে যাও তবে আল্লাহ তোমরা যা কর সে বিষয়ে সম্যক অবগত। (সুরা নিসা : আয়াত ১৩৫)