কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতরবৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদুল ফিতরপবিত্র কাবা শরীফ থেকে তিন কিলোমিটার দূর গেলো তারাবির নামাজের কাতার
No icon

রমযান মাস আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত

মুমিন বান্দার জন্য রমযান মাস আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। তিনি এই মাসের প্রতিটি দিবস-রজনীতে দান করেছেন মুষলধারা বৃষ্টির মতো অশেষ খায়ের-বরকত। জাগতিক জীবনে পাথেয় লাভের বিশেষ সময়কাল থাকে। কৃষক যেমন অপেক্ষায় থাকেন কখন ফসল ফলানোর সময় আসবে। ব্যবসায়ী অপেক্ষায় থাকেন কবে আসবে নির্ধারিত মৌসুম। মৌসুমে যদি ব্যবসা করা যায়, ঠিক সময়ে যদি কার্যসিদ্ধি করা যায়, তাহলে বাকি সময়টা ফলভোগ করা যাবে। ঠিক তেমনি আখেরাতের পাথেয় অর্জনেরও একটা উৎকৃষ্ট মৌসুম আছে, তা হলো পবিত্র মাহে রমযান।

রমযান মাস হলো ইবাদতের বসন্তকাল। ঋতুরাজ বসন্ত যেমন প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ এনে দেয়। তেমনি রমজান মাস সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য নেয়ামত স্বরূপ রহমত,বরকত, মাগফিরাত, তাকওয়া লাভ ও ইবাদতের সীমাহীন সুযোগ এনে দেয়। মহান আল্লাহতায়ালা এ মাসে মুমিনদের ওপর অবারিত রহমতের বারিধারা বর্ষণ করেন। মুমিনদের জন্য মাগফিরাতের সব আয়োজন প্রস্তুত করে রাখেন। এ মাসের প্রভূত কল্যাণের মাধ্যমে মুক্তিপাগল মুমিনরা শুদ্ধতার নির্ঝরনী ফোয়ারায় স্নিগ্ধ করে তাদের হৃদয়কে। এ মাসে জান্নাতি সমীরণ বয়ে যায় প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের হৃদয়ে।

দেখা যায়, যে মানুষটা বছরের অন্যান্য দিনগুলোতে মসজিদমুখি হয় না, মুয়াজ্জিনের আযান তার কানে পৌঁছে না, সে-ও রমযান এলে মসজিদমুখি হয়, পুরো রমযানটা ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দেয়। রমজান মাস সাওয়াব অর্জনের বিস্তৃত ফলন মাঠ। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ভালো কাজে ব্যয় হয়, অবহেলা আর খেয়ালিপনায় কেটে না যায়, সেজন্য নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের বিভিন্ন ফজিলতের কথা শোনাতেন, আমলের প্রতি উৎসাহ দিতেন। এ মাসের ফজিলতের কথা বলতে গিয়ে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে নফল ইবাদত করে, সে যেন অন্য মাসের ফরজ আদায় করে। আর যে ফরজ আদায় করে, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করে। (সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস : ১৮৮৭)।

অন্যত্র বলেন, ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রমযান মাসের রোযা পালন করলো এবং ইবাদতের উদ্দেশে রাত জেগে রইলো, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশা করে লাইলাতুলকদরের রাত জেগে থাকে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হয়। (তিরমিজি হাদিস : ৬৮৩)। এ মাস আল্লাহমুখী হওয়া, তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়া, তাকওয়া হাছিল করা এবং গুনাহ থেকে পাক-ছাফ হয়ে তাঁর নৈকট্য অর্জনের মোক্ষম সময়। চরিত্র মাধুর্যম-িত করে, কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে, অন্তরকে ধুয়েমুছে পূত-পবিত্র করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার নূর জ্বালানোর সর্বোত্তম সময়। কীভাবে বেশি থেকে বেশি আমলের মাধ্যমে নিজের ঈমানী যিন্দেগী দ্যুতিময় করে তোলা যায়, এ মাস হল সেই চর্চা ও প্রচেষ্টার উপযুক্ত মুহূর্ত। আর তাই তো রমযানের চাঁদ উঠতেই ঘোষণা হতে থাকে : হে কল্যাণ অন্বেষী, তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর, নেকীর পথে তুমি আরো বেগবান হও। হে অকল্যাণের যাত্রী, তুমি নিবৃত্ত হও, নিয়ন্ত্রিত হও। (জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮২;)।

নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু যে ফজিলতের কথা শোনাতেন তা নয়, বরং আগাম শতর্কবার্তাও দিয়েছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মিম্বারের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন। জিবরাইল আলাইহিসসালাম বদদোয়া করে বললেন, যে ব্যক্তি রমযান পেলো অথচ নিজের গুনাহ ক্ষমা করাতে পারলো না, সে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে দূরে সরে যাক। আর আল্লাহর তাআলার রহমত-বঞ্চিত হওয়াটাকেই পরিভাষায় গজব বা লানত বলা হয়। প্রতি উত্তরে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমীন অর্থাৎ হে আল্লাহ! কবুল করে নিন! (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান ১৬৬৮)। অপর বর্ণনায় এসেছে, জিবরাইল আলাইহিসসালাম বলেছিলেন: ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমযান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন আমি বললাম, আমীন। (আলআদাবুল মুফরাদ ৬৪৬)

একটু অন্তরটাকে নাড়া দিন। অনুভূতিকে জাগ্রত করুন, যে বিষয়ে জিবরাইল আলাইহিসসালামের মত ফেরেশতা বদদোয়া করেছেন, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীন বলেছেন। তাও আবার মসজিদে নববিতে! সে বিষয়টা কতটা নাজুক ও হৃদয়স্পর্শী হতে পারে। এমনিতে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেকদোয়া কিংবা বদদোয়া আল্লাহ তাআলার কাছে মকবুল, সেখানে আবার যুক্ত হয়েছে মসজিদে নববি, যা দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান হিসেবে আমরা সকলেই জানি। সুতরাং রমযান পাওয়ার পরেও যে ব্যক্তি গুনাহ মাফ করাতে পারবে না; না জানি সে কত বড় বদ নসিব!

খুবই আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এমন একটি সময় আমরা অতিবাহিত করছি, যখন রমজান সম্পর্কে বহু মানুষের ধ্যান ধারণা আগেকার দিনের মতো নেই। তারা এই মাসকে খাবার-দাবার, পান-পানীয়, মিষ্টি-মিষ্টান্ন, রাতজাগা ও স্যাটেলাইট চ্যানেল উপভোগ করার মৌসুম বানিয়ে ফেলেছে। এর জন্য তারা রমজান মাসের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে; এই আশংকায় যে- কিছু খাদ্য দ্রব্য কেনা বাদ পড়ে যেতে পারে অথবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এভাবে তারা খাদ্যদ্রব্য কেনা, হরেক রকম পানীয় প্রস্তুত করা এবং কী কী অনুষ্ঠান দেখবে, আর কী কী দেখবে না সেটা জানার জন্য স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর প্রোগ্রামসূচী অনুসন্ধান করার মাধ্যমে এর জন্য প্রস্তুতি নেয়। অথচ রমজান মাসের তাৎপর্য সম্পর্কে সত্যিকার অর্থেই তারা অজ্ঞ। তারা এ মাসকে ইবাদত ও তাকওয়ার পরিবর্তে উদরপূর্তি, চক্ষুবিলাস এবং আনন্দ উল্লাসের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।

আবার আমরা অনেকে মনে করি, যেহেতু রমযান রহমতের মাস, মাগফিরাতের মাস, নাজাতের মাস সুতরাং কোনো না কোনোভাবে মাফ তো পেয়েই যাব! এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল নয় তবে পরিপূর্ণ নয়। কেননা, এই মাসে আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে মাফ করতে চান। তবে বিনা শর্তে নয়। শর্ত হল, যখন আমরা মাসটিতে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকবো তখনই তিনি আমাদেরকে মাফ করবেন। (মুসলিম : ৩৪৯)।