ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা অপরিসীম। পৃথিবীর বুকে মানবতার ধর্ম হিসেবে ইসলাম সর্বপ্রথম শ্রমিক সমাজের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে শ্রমের মর্যাদা যেমন প্রদান করা হয়েছে, তেমনি একজন শ্রমিকের যথাযোগ্য মর্যাদাও সুনিশ্চিত করা হয়েছে। যা মহান রব কর্তৃক রাসুলুল্লাহর (সা.) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেননা বিশ্বনবি (সা.) যখন এই পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন; তখন চারিদিকে শোষক-শোষিতের সম্পর্ক বিরাজ করেছিল। শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হতো, মালিক কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হতো। ঠিক সেই মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবিকে (সা.) ধরণীর বুকে পাঠিয়ে শ্রম ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করেন।
সবার উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, قَالَ اللَّهُ ثَلاَثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ، وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ، وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ، وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদি হব। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো, তার বিরুদ্ধে জয়ী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পূর্ণরূপে কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পূর্ণ মজুরি দেয় না। (বুখারি: ২২২৭)
এমনকি শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদানের তাগিদ দিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলাও বলেন, یٰۤاَیُّها الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَوۡفُوۡا بِالۡعُقُوۡدِ
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তিসমূহ পূর্ণ করো। (সুরা মায়িদাহ: ০১)
এছাড়া শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রদানে রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আরও অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন নিজে ন্যায্য মজুরি পরিশোধ করেছেন, অনুরূপ তাঁর সাহাবা এবং খলিফাগণও পরিশোধ করেছেন। এমনকি কর্ম সম্পাদন হওয়া মাত্রই একজন শ্রমিককে প্রাপ্য মজুরি প্রদানের নির্দেশনাও আছে।
এ ব্যাপারে তাগিদ প্রদান করে নবিজি (সা.) বলেন, أَعْطُوا الأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ
অর্থাৎ শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার পূর্বে তোমরা তার মজুরি দাও। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৪৪৩)
আলোচ্য আয়াত ও হাদিসসমূহ দ্বারা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, একজন শ্রমিকের মৌলিক অধিকার হচ্ছে তার ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি। আর শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি প্রদান করা প্রতিটি মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য এবং প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য। কেননা যারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে অর্থাৎ শ্রমিককে তার ন্যায্য মূল্য প্রদান করে, তারা প্রকৃত ঈমানদার। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَالَّذِیۡنَ همۡ لِاَمٰنٰتِهمۡ وَعَهدِهمۡ رٰعُوۡنَ
অর্থাৎ আর তারাই প্রকৃত মুমিন; যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সুরা মুমিনুন: ০৮)
তবে এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে, শুরুতেই মজুরি নির্ধারণ করে নেওয়া। এতে পারস্পরিক বোঝাপোড়ার মাধ্যমে ন্যায় ও ইনসাফ বজায় থাকে। বিধায় মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়। এ ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করে নবিজি (সা.) বলেছেন, منِ اسْتَأجر أجيراً، فَلْيُسَلِّمْ لَهُ أَجرَتَهُ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে লাগাবে, সে যেন তাঁর পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে লাগায়। (বুলুগুল মারাম: ৯১৪)
মনে রাখা উচিত, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি পরিশোধ না করা হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা চাইলে হাক্কুল্লাহ তথা আল্লাহর অধিকার; যা ঈমান, নামাজ, রোজা প্রভৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এগুলো যথাযথভাবে আদায় না করলে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু হাক্কুল ইবাদ লঙ্ঘনের গোনাহ ক্ষমা করবেন না। কারণ তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলে তখনই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
দৈনন্দিন জীবনে শ্রমিক সমাজের ন্যায্য মজুরি প্রদানে সবার সতর্ক থাকা উচিত। যেন হাক্কুল ইবাদ লঙ্ঘনের দায়ে কিয়ামতের মাঠে আল্লাহর দরবারে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়। এ কারণে পৃথিবীর বুকে শ্রমিকের যথাযোগ্য মর্যাদা ও মজুরি নির্ধারণে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কেননা ন্যায্য মজুরি শ্রমিকের অধিকার। আল্লাহ সবাইকে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের তৌফিক দান করুক, আমিন।