যেসব জায়গায় জুমার নামাজ শুদ্ধ হয় নাঅজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর
No icon

ইসলামের দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্নতা

ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে অত্যন্ত ভালোবাসে ও পছন্দ করে। নোংরামি ও কদর্যপনাকে আদৌ ভালোবাসে না ও পছন্দ করে না। ইসলাম পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও পবিত্র থাকার প্রতি উৎসাহিত করে। অপরিচ্ছন্ন, অপরিপাটি ও অপবিত্র থাকতে বারণ করে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও পবিত্র দেখতে চায়। সে তার অনুসারীদের নোংরা, ময়লা ও আবর্জনাপূর্ণ দেখতে চায় না। তাই ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের জন্য সমীচীন হলো সবসময় পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও পবিত্র থাকা। নোংরামি, ময়লা, আবর্জনা ও কদর্যপনা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোকপাত করছি।
পরিচ্ছন্নতা ঈমানের শাখা : ইসলামের দৃষ্টিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে একে ঈমানের শাখা বলে অনন্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ঈমানের সত্তরটিরও কিছু বেশি শাখা রয়েছে। অথবা ষাটটির কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এ কথা স্বীকার করা। আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে চলাচলের রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা ঈমানের একটি বিশেষ শাখা (সহিহ মুসলিম : ৫৯)

ঈমান আনয়ন করলে যেমনিভাবে একদিন না একদিন জান্নাতে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায় ঠিক তেমনিভাবে ঈমান আনয়ন করার সাথে সাথে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকলেও জান্নাতে যাওয়ার বিষয়টি সহজতর হয়। কেননা হাদিস শরিফে পবিত্রতা অবলম্বনকে ঈমানের অর্ধেক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত আবু মালিক আশআরি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক অংশ। (সহিহ মুসলিম : ৪২২)


পবিত্র থাকার নির্দেশ : ইসলাম চায় একজন মানুষ সর্বাবস্থায় পবিত্র থাকুক। এ জন্য মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পবিত্রতার সাথে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বীর্যপাত হওয়ার পর গোসল করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। প্রস্রাব-পায়খানার পর অজু করার আদেশ দিয়েছেন। অজু- গোসলের জন্য পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,হে মুমিনরা, যখন তোমরা সালাতের জন্য উঠো তখন স্বীয় মুখমণ্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং পদযুগল গিঁঠসহ। যদি অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ণ হও, অথবা প্রবাসে থাকো অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো, অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও- অর্থাৎ স্বীয় মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদের অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সূরা মায়েদা : ০৬)


বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখা : ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও আশপাশের পরিবেশ ও আঙ্গিনা পরিচ্ছন্ন রাখা সুস্থ রুচির পরিচায়ক। সুস্থ রুচি ও মননের অধিকারী কোনো ব্যক্তি অপরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ভালোবাসেন। তাই মুসলমানদের জন্য করণীয় হলো নিজেদের ঘরবাড়ি, উঠোন, আঙ্গিনা ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। মহানবী সা: ঘরবাড়ি ও আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত সালিহ ইবনু আবু হাসসান রহ: বলেন, আমি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ:-কে বলতে শুনেছি, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র এবং পবিত্রতা ভালোবাসেন। তিনি পরিচ্ছন্ন ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তিনি মহান ও দয়ালু, মহত্ত্ব ও দয়া ভালোবাসেন। তিনি দানশীল, দানশীলতাকে ভালোবাসেন। সুতরাং তোমরাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকো। আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, তোমাদের আশপাশের পরিবেশকেও পরিচ্ছন্ন রাখো এবং ইহুদিদের অনুকরণ করো না। সালিহ বলেন, আমি এ প্রসঙ্গে মুহাজির ইবনু মিসমারের কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি বলেন, আমির ইবনু সাদ তার পিতার সূত্রে নবী সা: থেকে একই রকম হাদিস আমার কাছে বলেছেন, তোমাদের আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখো।(সুনানে তিরমিজি : ২৭৯৯)


দশটি স্বভাবজাত বিষয় : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সাথে সম্পৃক্ত কিছু স্বভাবজাত বিষয় রয়েছে। সেগুলোকে স্বভাবের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে সম্পন্ন করা হলে জীবন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পবিত্র ও সুশৃঙ্খল হয়। দশটি স্বভাবজাত বিষয়ের কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, দশটি কাজ স্বভাবজাত কর্মের অন্তর্ভুক্ত। মোচ খাঁটো করা, দাড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দিয়ে ঝাড়া, নখ কাটা, আঙুলের গিরাগুলো ধোয়া, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের পশম মুণ্ডন করা ও পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা।রাবি জাকারিয়্যা বলেন, হাদিসের বর্ণনাকারী মুসআব বলেন, দশমটির কথা আমি ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। (সহিহ মুসলিম : ৪৯২)

মোচ খাঁটো করা, নখ কাটা, নাভির নিচের পশম মুণ্ডন করা ও বগলের পশম উপড়ে ফেলার মতো কাজগুলো সম্ভব হলে প্রতি সপ্তাহে একবার করা উত্তম, অন্যথায় পনেরো দিনে একবার করবে। তাও সম্ভব না হলে মাসে একবার করবে। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই যেন চল্লিশ দিন অতিবাহিত না হয়। হজরত আনাস ইবনু মালিক রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের জন্য গোঁফ ছাঁটা, নখ কাটা, নাভির নিম্নভাগের লোম চেঁছে ফেলার ও বগলের পশম উপড়ে ফেলার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যে, আমরা যেন এ কাজগুলো চল্লিশ দিনের বেশি সময় পর্যন্ত ফেলে না রাখি। বর্ণনাকারী বলেন, আরেকবার চল্লিশ রাতের কথাও বলেছেন।(সুনানে নাসায়ি : ১৪)


নির্দিষ্ট স্থানে প্রস্রাব-পায়খানা করা : যত্রতত্র প্রস্রাব-পায়খানা করলে পরিবেশ দূষিত হয় ও রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাই নির্ধারিত স্থানে প্রস্রাব-পায়খানা করার প্রতি ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। মানুষের চলাচলের রাস্তায় ও বিশ্রামের জায়গায় প্রস্রাব-পায়খানা করলে পরিবেশ দূষিত হওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অভিসম্পাত ও গালিগালাজের পাত্র হয়ে যায়। এ জন্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের চলাচলের রাস্তায় ও বিশ্রামের ছায়ায় প্রস্রাব-পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা অভিসম্পাতযোগ্য দুটি কাজ থেকে দূরে থাকো। সহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, অভিসম্পাতযোগ্য সে কাজ দুটি কী, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন,মানুষের যাতায়াতের চলাফেরার রাস্তায় অথবা তাদের বিশ্রাম নেয়ার ছায়ায় প্রস্রাব-পায়খানা করা।(সহিহ মুসলিম : ৫০৬)

অন্য আরেকটি হাদিসে স্থির পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা জমাটবদ্ধ পানিতে প্রস্রাব করলে তাতে নোংরামির সৃষ্টি হয় ও অজু-গোসলে ব্যবহার করার অযোগ্য হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তুমি এমনটি করো না যে, চলন্ত নয় এমন জমা পানিতে প্রস্রাব করবে তারপর আবার তা থেকে গোসল করবে।(সহিহ মুসলিম : ৫৪৪)
জুমার দিনে গোসল করা : জুমার দিন মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের মতো। এই দিনে মসজিদে মসজিদে বহু মানুষ জমায়েত হয় ও জুমার সালাত আদায় করে। এ দিন যদি কোনো ব্যক্তি অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় মসজিদে গমন করে, তাহলে তার দ্বারা অন্য মানুষের কষ্ট হতে পারে। তার শরীরের দুর্গন্ধের কারণে অন্য মানুষের ইবাদতে বিঘতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই ইসলাম প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানদেরকে জুমার দিনে গোসল করার নির্দেশ প্রদান করেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ জুমার সালাতে আসলে সে যেন গোসল করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৭৭) অন্য আরেকটি হাদিসে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার দিনে গোসল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে একে ওয়াজিব বলে আখ্যায়িত করেছেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিন প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত মুসলিমের ওপর গোসল করা ওয়াজিব।(সহিহ বুখারি : ৮৫৮)
পাত্রে ঢোকানোর আগে হাত ধোয়া : পানি না থাকা অবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম অনেকসময় কেবল ঢিলা কুলুপ ব্যবহার করতেন। প্রচণ্ড গরমের কারণে শরীর ঘর্মাক্ত হতো। ফলে তাদের লজ্জাস্থান নোংরা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ঘুমানোর পর অনেকসময় লুঙ্গি বা কাপড় খুলে যায়। এ অবস্থায় লজ্জাস্থানে বা মলদ্বারে হাত যাওয়া অসম্ভব নয়। ঘুমন্ত অবস্থায় মলদ্বারে বা লজ্জাস্থানে হাত গেলে তা ময়লাযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য আল্লাহর রাসূল সা: ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর না ধুয়ে অজুর পাত্রে হাত ঢোকাতে বারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন অজু করে তখন সে যেন তার নাকে পানি দিয়ে ঝাড়ে। আর যে শৌচকার্য করে সে যেন বিজোড় সংখ্যায় ঢিলা ব্যবহার করে। আর তোমাদের কেউ যখন ঘুম থেকে জাগে তখন সে যেন অজুর পানিতে হাত ঢোকানোর আগে তা ধুয়ে নেয়; কারণ তোমাদের কেউ জানে না যে, ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত কোথায় থাকে।(সহিহ বুখারি : ১৬২)
ঋতু অবস্থায় সহবাস : পিরিয়ড চলাকালে বৃদ্ধ নয় এমন প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের লজ্জাস্থান দিয়ে একপ্রকার দূষিত রক্ত নির্গত হয়। সেই রক্ত নিতান্ত নোংরা, অশুচি ও অপবিত্র। নারীদের পিরিয়ডকালীন এই অবস্থাকে অপরিচ্ছন্নতা, অশুচি ও অপবিত্রতার অবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন অশুচি অবস্থায় স্ত্রীলোকদের সাথে সহবাস করতে বারণ করা হয়েছে। আল কুরআনে এসেছে, আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে ঋতু সম্পর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র। কাজেই তোমরা ঋতু অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়। যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন করো তাদের কাছে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাহকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন। (সূরা বাকারাহ : ২২২)