ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিকে যদি বলা হয়, তোমার যেকোনো চাহিদা পূরণ করা হবে। তবে আসামি মাত্রই সবার আগে বলবে যে, আমার ফাঁসি মওকুফ করা হোক। মহান আল্লাহর আমাদের ক্ষমা করাটাও সেরকম। আমাদের যাপিত জীবনে হেন কোনো অপরাধ নেই যা আমরা করি না। শত শত অপরাধ অহির্নিশ আমরা করে চলেছি। হিসাব করলে একবার কেন জাহান্নাম, শতবারের জন্য বরাদ্দ হতে পারে। সেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে রব আমাদের জন্য অফার করেছেন ক্ষমা এবং জান্নাতের। আহ্বান করেছেন এই দুটো নেয়ামতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করছে ‘আর নিজ পালনকর্তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের জন্য ছুটে চল যার প্রশস্ততা এ পরিমাণ যে, তার মধ্যে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী ধরে যাবে। তা সেসব মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে যারা সচ্ছল এবং অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে। যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদের ভালোবাসেন এবং তারা সেই সব লোক যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা আছে যিনি গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। এরাই সেই লোক, যাদের পুরস্কার হচ্ছে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং সেই জান্নাত যার তলদেশে নহর প্রবাহিত। যেখানে তারা চিরদিন থাকবে। তা কতই না উৎকৃষ্ট, প্রতিদান যা আমলকারীরা লাভ করবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৩-১৩৬)
১৩৩ নং আয়াতে মহান রব আহ্বান করেছেন ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটতে। এর পরের দুই আয়াতে বলেছেন চারটি গুণের কথা। শেষে ১৩৬ নং আয়াতে এই সুসংবাদ দিয়েছেন যে, উল্লিখিত চারগুণের অধিকারীরাই রবের তরফ থেকে ক্ষমা এবং চিরস্থায়ী জান্নাতপ্রাপ্ত হবেন। আয়াতে বর্ণিত সেই চারটি গুণ হলোÑ
এক. সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় ব্যয় করা। সচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করা তো সহজসাধ্য। কিন্তু অসচ্ছল অবস্থায়? আল্লাহর নির্দেশনা হচ্ছে অসচ্ছল অবস্থায়ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দান করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘আর যার জীবিকা সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয়েছে সে যেন আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচ করে...কোনো সঙ্কট দেখা দিলে আল্লাহ তারপর স্বাচ্ছন্দ্যও সৃষ্টি করে দেবেন।’ (সূরা ত্বলাক, আয়াত : ০৭)
টিউব অয়েলে অনেক সময় পানি নাগালের বাইরে চলে যায়। তখন সামান্য পানি দিয়ে হ্যান্ডেল চাপতে থাকলে পানির প্রবাহ ফিরে আসে। অর্থাৎ সামান্য পানি অধিক পানি নিয়ে আসে। অসচ্ছল অবস্থায় দানের বিষয়টি তেমন। অসচ্ছলতার দরুণ হয়তো আমি বেশি কিছু ব্যয় করতে পারবো না। কিন্তু সে সময়ের কিঞ্চিৎ দান আমার সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হবে।
দুই. রাগ হজম করা। এক ব্যক্তি নবীজি সা:কে বললেন, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ করো না।’ ওই ব্যক্তি কয়েকবার তা বললেন, নবীজি সা: প্রতিবারই বললেন, ‘রাগ করোনা।’ (বুখারি, হাদিস নং-৬১১৬)
ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘হে আদম সন্তান! রাগান্বিত হলে আমাকে স্মরণ করবে, তাহলে আমি রাগান্বিত যখন হবো তোমাকে স্মরণ করব। ফলে তোমাকে ধ্বংসপ্রাপ্তদের মধ্যে ধ্বংস করবো না।’ (ইবনে কাসির, উল্লিখিত আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য)। রাগ প্রশমনের প্রক্রিয়া হিসেবে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ রাগান্বিত হয়ে পড়লে তখন দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়বে। এতে রাগ কমে গেলে তো ভালো; নইলে সে শুয়ে পড়বে।’ (আবু দাউদ : ৪৭৮২)
রাগ দূর করতে নবীজি অজুর পরামর্শও দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে; শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে আগুন থেকে আর একমাত্র পানির মাধ্যমেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তার উচিত অজু করা।’ (আবু দাউদ : ৪৭৮৪)
তিন. ক্ষমা করা। এটা আল্লাহর গুণ। এ জন্য তাঁকে গফুর নামে অভিহিত করা হয়। প্রিয় নবী সা:-এরও অনন্য একটি চরিত্র ছিল ক্ষমা করা। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে নবীজি সা: বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো প্রতিশোধ নেই; আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’ হজরত উমর রা: বলেন, ‘মহানবী সা:-এর এমন উদার মন দেখে সেদিন লজ্জায় নুয়ে পড়েছিলাম। আমি প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, আনন্দ করছি। এদিকে তিনি চিরশত্রুদের ক্ষমার সংবাদ শোনাচ্ছেন।’
রাসূল সা: বলেছেন, সাদাকা করাতে সম্পদের ঘাটতি হয় না। ক্ষমা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধিই করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয়ী হলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম : ২৫৮৮)
বিখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরী রহ. এক রাতে দোয়া করছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার ওপর যে জুলুম করেছে তাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। এক লোক অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি নিজের ওপর জুলমকারীর জন্য দোয়া করছেন! আমার তো মন চাচ্ছে আপনার ওপর জুলুম করি, যেন আপনি আমার জন্য ক্ষমার দোয়া করেন।’ হাসান রহ. বললেন, ‘কেন তুমি জানো না! আল্লাহ আল কুরআনে বলেছেন, (অর্থ) ‘তবে যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধনের চেষ্টা করে, তার প্রতিদান আল্লাহর দায়িত্বে রয়েছে।’ (সূরা শূরা, আয়াত : ৪০) আমি প্রতিদান আল্লাহর কাছ থেকে নিতে চাই। আমার লজ্জা হয়, আমি হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব, অথচ মানুষকে ক্ষমা করব না।’
চার. অশ্লীল কাজ বা কোনো গুনাহ করে ফেললে সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং সেই অপরাধে অবিচল না থাকা। মানে তওবা করা। রাসূল সা: বলেছেন, ‘কেউ যদি কোনো গুনাহ করে ফেলে, অতঃপর ভালো করে অজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি : ৪০৬)
হজরত আনাস রা: বলেন, ‘এই আয়াত (চার নং গুণ সম্বলিত আয়াত) নাজিল হলে ইবলিশ কেঁদে দেয়। (তাফসিরে আব্দির রাযযাক, ১/১৩৭)