যেসব জায়গায় জুমার নামাজ শুদ্ধ হয় নাঅজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর
No icon

আল্লাহর ওপর ভরসা কী?

সূরা তাওবার ৫১ নম্বর আয়াত কুরআনের অন্যতম শক্তিশালী আয়াতগুলোর একটি। কুরআনের সব আয়াতই প্রিয় এবং আশীর্বাদপুষ্ট। কিন্তু কিছু কিছু আয়াতের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
এই আয়াতটি সবার মুখস্থ করা ভালো। কারণ, আয়াতটি সত্যিই বিপদের সময় আমাদের অন্তরে এক ধরনের নিরুদ্বেগ স্বাচ্ছন্দ্য এবং প্রশান্তি নিয়ে আসে। এই আয়াতটি তাবুক যুদ্ধের চাপ মোকাবেলায় খুব কাজে আসে। বড় ধরনের একটি কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে যাচ্ছেন সাহাবিরা। সময়টি ছিল দারুণ প্রতিকূল। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে তাদেরকে ক্ষেত খামারের দায়িত্ব পরিত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছিল। মদিনায় তাদের অবস্থানটা যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন তাদেরকে মদিনা ত্যাগ করতে হয়েছিল। তীব্র গরমের ভেতর দিয়ে তাদেরকে হাজার মাইল ভ্রমণ করতে হয়েছিল। যুদ্ধটা হওয়ার কথা ছিল তাদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী রোমান সেনাদের সাথে।
তখন আল্লাহ তাদেরকে বললেন, ‘বলো, আমাদেরকে শুধু তা-ই আক্রান্ত করবে যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে রেখেছেন। তিনিই আমাদের রক্ষক, আর আল্লাহর ওপরই যেন মুমিনরা তাওয়াক্কুল করে’ (৯ : ৫১)।
এটি কত চমৎকার একটি আয়াত! এখানে বান্দার সাথে তার সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এখানে কুরআনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা ‘তাওয়াক্কুল’ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভর করার এই আয়াতটি আমাদের তাওয়াক্কুলের প্রাথমিক উপকার সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। আপনার যদি তাওয়াক্কুল থাকে, দুনিয়ার সমস্যাগুলো আপনাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। যদি তাওয়াক্কুল থাকে, পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, বাইরে যত শক্তিশালী ঝড়ই থাকুক না কেন, আপনার অন্তর প্রশান্তিতে পূর্ণ থাকবে।
কেন? কারণ, আপনি জানেন কোনো কিছুই ঘটবে না, যদি না তিনি ইচ্ছা করেন। আর তিনি কে? তিনি আমার মাওলা। তিনি আমার রক্ষক। তিনিই সেই সত্তা যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমার যত্ন নেন। আমার প্রতিপালন করেন। তাহলে কেন আমি উদ্বিগ্ন হবো? কেন আমি অশান্ত হয়ে উঠব? কেন আমি দুঃখ কাতর হয়ে পড়ব?
এটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা হোক, আর্থিক সমস্যা হোক, সামাজিক সমস্যা হোক, কিছুই ঘটবে না, যদি না আল্লাহ কিছু ঘটানোর ইচ্ছা করেন। আমার চরম শত্রুরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যদি না আল্লাহ এর ইচ্ছা করেন। আমার ওপর কারো কোনো ক্ষমতা নেই, যদি না আল্লাহ এর ইচ্ছা করেন। কোনো আর্থিক সমস্যাই আমাকে চাপে ফেলতে বা আমার ওপর বোঝা হয়ে দেখা দেবে না, যদি না আল্লাহ এর ইচ্ছা করেন। তাই, কেন আমি কাউকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবো? আমার তাওয়াক্কুল আল্লাহ তায়ালার ওপর রাখতে হবে।
এই আয়াত আমাদের কাছে আরো ব্যাখ্যা করে তাওয়াক্কুল বলতে কী বোঝায়? তাওয়াক্কুল হলো একটি বিশেষ মানসিক অবস্থার নাম। তাওয়াক্কুল হলো একটি আধ্যাত্মিক অবস্থার নাম। তাওয়াক্কুল হলো অন্তরের একটি তাত্ত্বিক বিশ্বাসের নাম। আপনার কাজের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে না। আপনার কর্মপদ্ধতিতে এটি কোনো পরিবর্তন আনে না। আপনি কিভাবে দুনিয়া দেখেন, দুনিয়াকে কিভাবে উপলব্ধি করেন এটা তাতে পরিবর্তন আনে। তাওয়াক্কুল আপনার কাজে-কর্মে পরিবর্তন আনবে না। তাওয়াক্কুল আপনার অনুভূতিতে পরিবর্তন আনবে। তাওয়াক্কুল হলো একটি হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
সাহাবারা তবু অভিযানের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যা যা প্রয়োজন ছিল তার সবই তারা সাথে নিলেন। যা কিছু বস্তাবন্দী করা দরকার, করলেন। নিজেদের বর্ম পরিধান করলেন। যুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন। তাওয়াক্কুলের কারণে কোনো কিছুতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু, আল্লাহ বললেন, ‘চিন্তা করো না। আমি না চাইলে কিছুই ঘটবে না।’ খুব চমৎকার একটি হাদিস আছে যাতে তাওয়াক্কুলের ধারণাটির একটি সুন্দর সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের রাসূল সা: বলেছেন, ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মুমিনের চেয়ে প্রিয়’। এখানে শক্তিশালী বলতে শক্তিশালী ঈমানকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু, এর দ্বারা আবার জীবনের সব ক্ষেত্রের শক্তিমত্তাকেও বোঝায়। আর সব মুমিনের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে।’ ‘তোমার উপকারে আসবে এমন কিছুর জন্য আগ্রহী হও’ এবং এটি অর্জন করতে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো এবং অক্ষম হয়ে থেকো না।’
এই হাদিসের সাথে তাওয়াক্কুলের কী সম্পর্ক? খুব সহজ। আমাদের রাসূল সা: বলেছেন, ‘যখন বুঝতে পারো যে কিছু একটা তোমার উপকারে আসবে তখন সেটি অর্জন করার জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করো। তোমার উপকারে আসবে এমন কিছুর জন্য আগ্রহী হও।’
যদি চাকরি করতে চাও ডিগ্রি অর্জন করো। কোম্পানিতে নিজের প্রমোশন চাও? এর জন্য যে যে প্রচেষ্টা করতে হবে, করো। যা তোমার উপকার করবে তার জন্য আগ্রহী হও। এটি হালাল। এরপর রাসূল সা: বলেন, ‘এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো।’ তোমার হাত তুলে আল্লাহকে বলো, ও আল্লাহ! আমার জন্য এর অর্জন সহজ করে দিন। এরপর এবং ‘অক্ষম হয়ে থেকো না’। বাদ দিও না, পরিত্যাগ করো না, অলস হয়ে পড়ো না। ‘আজাজ’ মানে অলসতা। লক্ষ্য অর্জন করার প্রচেষ্টায় অলস হবে না। তোমাকে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে চেষ্টা করতে হবে। নিজের ডেস্কে অলস বসে থেকে তো তুমি প্রমোশন পাবে না।
পড়ালেখা না করলে, শিক্ষা অর্জন না করলে, যোগ্যতা অর্জন না করলে তো ভালো চাকরি পাবে না। সুতরাং, তোমার উপকারে আসবে এমন কিছু পেতে চাইলে এর জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করো। আল্লাহর কাছে দোয়া করো এবং অলস হইও না। হতাশ হয়ে ছেড়ে দিও না। এরপর কী? এরপর রাসূল সা: বলেন ‘যদি কোনো কিছু (বিপদ) তোমার ওপর আপতিত হয়...’ এমন কিছুর আশা তুমি করোনি। যদি অনেক চেষ্টার পরও লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারো, তখন দোষারোপ করবে না। এরূপ বলবে না যে, যদি আমি এরূপ করতাম তবে এরূপ এরূপ হতো।’ বরং বলো, ‘কাদ্দারাল্লাহু ওমা শায়া ফায়াল’ আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।’ যথেষ্ট চেষ্টা করার পরও যদি না পান তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করুন। আল্লাহ এটা আপনার জন্য লিখেননি। এটা আপনার কপালে ছিল না। আপনার ভাগ্যে ছিল না। তাহলে তাওয়াক্কুল আমাদের প্রচেষ্টায় কোনো প্রভাবে ফেলে না। এটি আমাদের চিন্তা-ভাবনায়, আমাদের উপলব্ধিতে প্রভাব ফেলে। এটি আমাদের কাজেকর্মে পরিবর্তন আনে না। আমরা যেভাবে বাস্তবতা বুঝি এটি তাতে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
এই সুন্দর আয়াতটি আমাদের মুখস্থ করে রাখা উচিত এবং কঠিন সময়ে এটি ব্যবহার করা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের তাওয়াক্কুল যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, আল্লাহর ওপর ভরসা করার পরিবর্তে আমরা তখন এই দুনিয়ার বিপদ-আপদ নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়ি। আর আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন, ‘যে কেউ আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট’ (৬৫ : ৩)। আল্লাহ তার যত্ন নেবেন।
রাসূল সা: আমাদের এই বিষয়ে একটি দোয়া শিখিয়ে গেছেন। দোয়াটি কুরআনে বর্ণিত আছে। যখন পরীক্ষায় পড়েন, বিপদ-আপদে পড়েন যদি এই কথাগুলো বলেন আল্লাহ আপনার দায়িত্ব নেবেন। যদি ঈমানের সাথে বলেন। সেই কথাগুলো হলো- ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’ (৩ : ১৭৩)! ওয়াকিল মানে এমন সত্তা যার ওপর আমি তাওয়াক্কুল করব, ভরসা করব।
রাসূল সা: আমাদের বলেছেন, ইবরাহিম আ: এ কথাগুলো বলেছিলেন যখন তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ফলে দেখেছেন? আল্লাহ কিভাবে তাঁকে রক্ষা করলেন। ইবরাহিম আ:কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তিনি শুধু বলেছিলেন ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল’। যখন নেবুচাদনেজারের সেনাবাহিনী আগুনের চুল্লি তৈরি করেছিল এবং তাঁকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তিনি শুধু বলেছিলেন ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল’। তখন আল্লাহ ইবরাহিম আ:-এর জন্য সেই আগুনকে সুন্দর একটি বাগানে পরিণত করলেন।
তাওয়াক্কুলের বাস্তবতা হলো- এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ওপর আমাদের আশা রাখি। আমাদের বিশ্বাস রাখি। কোনো কিছুই ঘটবে না যদি না তিনি এর ডিক্রি জারি করেন।
কিন্তু এর মানে এটা নয় যে, আমরা অলস হয়ে বসে থাকব। আরেকটি হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর ওপর যদি তোমাদের যথাযোগ্য তাওয়াক্কুল থাকত, আল্লাহ যেভাবে ডিজারভ করেন, তাহলে তিনি তোমাদের এমনভাবে জীবিকা সরবরাহ করতেন যেভাবে তিনি সব পাখিদের জীবিকা সরবরাহ করেন। তারা সকাল বেলা খালি পেটে তাদের বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে...’ কেউ জানে না কোথায় তারা তাদের শস্য পাবে। কেউ জানে না তাদের খাদ্য কোথা থেকে আসবে। ‘আর তারা ভরাপেটে তাদের নীড়ে ফিরে আসে’।
এই সুন্দর হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় তাওয়াক্কুলের আসল অর্থ কী তা বুঝতে। এর মানে এটি নয় যে, আপনি নীড়ে বসে থাকবেন। এর মানে এটি নয় যে, কিছু না করেই আপনি আশায় থাকবেন আল্লাহ আপনাকে দেবেন। না। পাখিগুলো ভোরবেলা নীড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং সমগ্র অঞ্চলে উড়ে বেড়ায়। তাদের আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল আছে আর তাই আল্লাহ তাদের খাবার সরবরাহ করেন। এমন উৎস থেকে যার আশা তারা করেনি।