প্রতিটি মানুষ সফলতা চায় এবং তা অর্জনে হাজারো চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত সফলতা কী এবং তা কিভাবে অর্জিত হয় তা অনেকের অজানা। সফলতার অর্থ প্রত্যেক মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়া এবং জীবন থেকে সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হওয়া। কিন্তু এমন পূর্ণাঙ্গ সাফল্য দুনিয়াতে অর্জিত হতে পারে না। এই সফলতা কেবল জান্নতে পাওয়া যাবে। জান্নাতেই মানুষের প্রত্যেক মনোবাঞ্ছা সর্বক্ষণ ও বিনা প্রতীক্ষায় অর্জিত হবে। তারা যা চাইবে, তাই পাবে। সেখানে কোন সামান্যতম ব্যথা ও কষ্ট থাকবে না। তাই একজন মুমিনের সে জান্নাতের অধিকারী হওয়া-ই প্রকৃত সফলতা। এই সফলতা কিভাবে অর্জিত হবে, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় তা উল্লেখ করেছেন। সূরা মু’মিনুনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা সফল মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে সাতটি গুনের কথা উল্লেখ করেছেন। যে ব্যক্তি সে সাতটি গুন অর্জন করবে সে জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে।
হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেনঃ রসূলূল্লাহ (সা.)-এর প্রতি যখন ওহী নাযিল হত, তখন নিকটবর্তী লোকদের কানে মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ ধ্বনিত হত। একদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা সদ্যপ্রাপ্ত ওহী শোনার জন্যে থেমে গেলাম। ওহীর বিশেষ অবস্থা সমাপ্ত হলে রসুলুল্লাহ্ (সা.) কেবলামুখী হয়ে বসে গেলেন এবং দোয়া পাঠ করতে লাগলেন: ‘হে আল্লাহ্ আমাদেরকে বেশী দান কর কম দিও না। আমাদের সম্মান বৃদ্ধি কর লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান কর বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ো না এবং আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাক এবং আমাদেরকে তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট কর।’ এরপর রসুলুল্লাহ্ (সা.) বললেন: এক্ষণে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে যাবে। এরপর তিনি সুরা মু’মিনুন এর প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। (মুসনাদে আহমদ-২২৩) উক্ত আয়াত গুলোর মধ্যে সাতটি গুনের কথা বলা হয়েছে।
এক. নামাযে ‘খুশু’ তথা বিনয়ী হওয়া: অর্থাৎ নামাযের ভিতরে নিজের দেহ-মনকে স্থীর রাখা। আল্লাহ ছাড়া নামাযে অন্যকোন কিছুর কল্পনা এবং নামাযে অনর্থক নড়াচড়া না করা ও দৃষ্টিকে সিজদার জায়গায় নিবদ্ধ রাখা। ফিকহের দৃষ্টিতে নামাযে এমন অনর্থক নড়াচড়া ও এদিক সেদিক দৃষ্টি দেয়া মাকরুহ এবং সাওয়াব হ্রাস পাওয়ার কারণ। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আবু যর থেকে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেনঃ নামাযের সময় আল্লাহ্ তাআলা বন্দার প্রতি সর্বক্ষণ রহমতের দৃষ্টি নিবন্ধ রাখেন যতক্ষণ না নামাযী অন্য কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ করে। যখন সে অন্য কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে, তখন আল্লাহ্ তাআলা তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন।-( নাসায়ী-১১৯৪)।
অন্য হাদিসে হাদিসে এসেছে নামাযে খুশু-খুযুর ঘাড়তি হলে সাওয়াব কম পাওয়া যায়। আম্মার ইবনু ইয়াসির রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, এমন লোকও আছে যারা সালাত আদায় করা সত্ত্বেও সালাতের রুকন ও শর্তগুলো সঠিকভাবে আদায় না করা এবং সালাতে পরিপূর্ণ একাগ্রতা ও খুশু-খুযু না থাকায় সালাতের পরিপূর্ণ সাওয়াব পায় না; বরং তারা দশ ভাগের একভাগ, নয় ভাগের একভাগ, আট ভাগের এক ভাগ,সাত ভাগের এক ভাগ, ছয় ভাগের এক ভাগ, পাঁচ ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ, তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধাংশ সাওয়াব পায়। ( আবু দাউদ-৭৯৬)।
দুই. অনর্থক বিষয়াদি থেকে বিরত থাকা: অর্থাৎ অনর্থক কথা অথবা কাজ, যাতে কোন ধর্মীয় উপকার নেই। হাদিস শরীফে অনর্থক বিষয়াদি পরিহার করাকে মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিন বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষেয়র জন্য স্যেন্দর্য হচ্ছে তার অনর্থক বাক্যালাপ পরিহার করা। ( তিরমিযি- ২৩২০)। ইমাম মালেক রা. বর্ণনা করেন যে, লোকমান আলাইহিস সালাম কে কেউ জিজ্ঞেস করল, কিসের কারণে আপনি এত বুযুর্গী পাইলেন? তিনি বললেন, সত্য কথা বলা, আমানতদারী, এবং অনর্থক কাজ পরিহার করার কারণে। (মুয়াত্তা মালিক-১৭)।
তিন. যাকাত আদায় করা: যাকাত এর আভিধানিক অর্থ পবিত্র করা। পরিভাষায় মোট অর্থ-সম্পদের একটা বিশেষ অংশ কিছু শর্তসহ দান করাকে যাকাত বলা হয়। যা ইসলামের পাঁচ স্তন্বের একটি। কুরাআন-সুন্নাহয় যাকাত আদায়ের গুরুত্ব,ফজীলত এবং অনাদায়ের কারণে আযাবের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ রয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীবুত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা ললাট, পার্শ ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। সেদিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিল। সুতরাং এক্ষণে স্বাদ গ্রহণ করো জমা করে রাখার। (সূরা তাওবাহ-৩৪-৩৫)। এছাড়া যাকাত শব্দের দ্বারা এখানে আত্মশুদ্ধিও উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ অন্তরকে সকল প্রকার পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা। শিরক, রিয়া, অহঙ্কার, হিংসা, শত্রুতা, লোভ-লালসা, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে নফসকে পবিত্র রাখাকে আত্মশুদ্ধি বলা হয়। এগুলো সব হারাম ও কবীরা গুনাহ্। পবিত্র কুরআনে এজাতীয় গুনাহ থেকে পবিত্র অন্তরের অধিকারীকে সফল এবং অপবিত্র অন্তরের অধিকারীকে ব্যথ ও মনরোথ বলা হয়েছ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সেই সফলকাম হবে, যে নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে। আর ব্যর্থকাম হবে সেই, যে তাকে গুনাহের মধ্যে ধসিয়ে দিবে। (সূরা শামস-৯, ১০)।
চার. যৌনাঙ্গকে হারাম থেকে সংযত রাখা: অর্থাৎ বিবাহিত স্ত্রী এবং দাসীদের ছাড়া সব পর নারী থেকে যৌনাঙ্গকে হেফাজত রাখা এবং স্ত্রী ও দাসীদের সাথে কামবাসনা পূর্ণ করার ক্ষেত্রেও শরীয়তের বিধিমালা মেনে চলা। হায়েজ, নেফাস এর সময় এবং নিষিদ্ধ স্থানে সহবাস করা থেকে বিরত থাকা। পাশাপাশি নিজের কামবাসনা পূর্ণ করার এদুটি বৈধ পথ ছাড়া অন্যকোন উপায়ে যৌনাচার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। যারা এই দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে পবিত্র কুরাআানে তাদেরকে তিরস্কৃত না হওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। আর যারা অবৈধ পথে যৌনাচার করবে তারা হবে সীমালঙ্গনকারী। (সূরা মু’মিনুন-৪-৫)।
পাঁচ. আমানত রক্ষা করা: আমানত একটি ব্যাপক শব্দ। হুকুকুল্লাহ এবং হুকুকুল ইবাদ সম্পকৃত যেকোন আমানত এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর হক সম্পকৃত আমানত হলো, আল্লাহর সকল আদেশগুলো পালন করা আর নিষেধ গুলো বর্জন করা। আর বান্দার হক সম্পৃক্ত আমানত হলো, কারো কাছে কেউ কোন অর্থ-সম্পদ জমা রাখলে তা যথাযথ হেফাজত করা এবং যথাসময়ে তা প্রত্যাবর্তন করা। এছাড়া কেউ কারো কাছে কোন গুপন কথা বললে সেটা গুপন রাখাও একটি আমানত। শরীয়ত সম্মত অনুমতি ব্যতিরেকে কারও গোপন তথ্য ফাঁস করা আমানতে খেয়ানত করার নামান্তর। আমানত রক্ষা করা মুমিনের আলামত আর তা খেয়ানত করা মুনাফিকের আলামত। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি। এক. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। দুই. যখন ওয়াদা করে ভঙ্গ করে। আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে। (বুখারী-৩২)।
ছয়. ওয়াদা পূর্ণ করা: বিভিন্ন সময় মানুষ কোন কাজ করা বা কাউকে কোন কিছু দেয়ার ওয়াদা করে থাকে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন ওয়াদা পূর্ণ করাও জরুরী। শরীয়ত সম্মত ওজর ব্যতিত তা খেলাপ করা জায়েয নয়। তেমনিভাবে যাপিত জীবনে মানুষ প্রয়োজনে একে অপরের সাথে দ্বীপাক্ষিক বিভিন্ন চুক্তি করে থাকে এবং উভয়পক্ষ তা পূর্ণ করাকে আবশ্যক মনে করে। এমন চুক্তি পূর্ণ করা ফরয এবং তা ভঙ্গ করা হারাম। আয়াতে একতরফা ওয়াদা বা দ্বীপাক্ষিক চুক্তি উভয় প্রকার অঙ্গীকারকে পূর্ণ করার কথা বলা হয়েছে । পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করো...। (সূরা মায়দা-১) হাদিস শরীফে ওয়াদা ভঙ্গকারীর দ্বীন নেই বলে হুশিয়ারি করা হয়েছে।
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব কম ভাষণ আমাদের সামনে দিয়েছেন এবং তাতে বলেছেন, যার আমানত নেই তার ঈমান নেই। আর যার ওয়াদা ঠিক নেই তার দ্বীন নেই। (মিশকাতুল মাসাবীহ-৩৫)।
সাত. নামায: পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে যথা সময়ে মুস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করা এবং নামাযের পাবন্দি করা। যথাসময়ে নামায আদায় করাকে হাদীস শরীফে উত্তম আমল বলা হয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথা সময়ে নামায আদায় করা। (বুখারী-৫০২)