যেসব জায়গায় জুমার নামাজ শুদ্ধ হয় নাঅজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর
No icon

তারাবির সালাত আদায় ও রাকাত সংখ্যা

রমজানে কিয়ামুল লাইল আদায়ে রাসূলুল্লাহ সা: অন্য সময়ের থেকে অধিক তাগিদ দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়তে সালাত পড়বে তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বুখারি-২০০৯) এ জন্য রমজানের কিয়ামুল লাইলকে উম্মতের আলেমরা অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সুন্নাত মুআক্কাদা বলে গণ্য করেছেন।

সাহাবিরা রমজানে তাঁর পেছনে জামাতে কিয়ামুল লাইল পালন করতে অতীব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ফরজ হওয়ার আশঙ্কায় তিনি একাকী তা আদায় করতেন এবং সাহাবিদেরকে এভাবে আদায় করতে পরামর্শ দেন। (সহিহ মুসলিম-১৮৬১)
পাশাপাশি তিনি জামাতে রমজানের কিয়াম আদায়ের ফজিলতে বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের কিয়ামুল লাইল শেষ করা পর্যন্ত ইমামের সাথে কিয়ামুল লাইল আদায় করবে তার জন্য পুরো রাত কিয়াম পালনের সওয়াব লেখা হবে। (জামে তিরমিজি-৮০৬)

সাহাবিরা ও পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমরা রমজানের কিয়ামুল লাইল আদায়ের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। যারা কুরআনের ভালো কারি বা হাফেজ ছিলেন না তারা অনেকসময় কোনো ভালো কারি বা হাফেজের পেছনে মসজিদে বা বাড়িতে ছোট জামাত করে তা আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময়ে ও তাঁর ওফাতের পরে প্রায় কয়েক বছর এভাবেই চলে।

খলিফা উমার রা: লক্ষ করেন, এভাবে মদিনার মসজিদে নববীতে ছোট ছোট জামাতে বা পৃথকভাবে একাকী অনেকেই সালাতুল ইশার পর কিয়ামুল লাইল আদায় করছেন। তখন তিনি সাহাবি উবাই ইবন কাবকে বলেন, মানুষরা দিবসে সিয়াম পালন করেন, কিন্তু অনেকেই ভালো হাফেজ বা কারি নন; কাজেই আপনি তাদেরকে নিয়ে জামাতে কিয়ামুল লাইল আদায় করেন। পাশাপাশি তিনি সুলাইমান ইবনে আবি হাসমাহ রা: নামক অন্য সাহাবিকে মহিলাদের নিয়ে মসজিদের শেষপ্রান্তে পৃথক জামাতে কিয়ামুল লাইল আদায় করার নির্দেশ দেন। মহিলাদের জামাতের ইমামতি তামিম দারি রা: নামে অন্য সাহাবিও করতেন। খলিফা উসমান ইবন আফ্ফান রা:-এর সময়ে তিনি সুলাইমান ইবনে আবি হাসমাহ রা:-এর ইমামতিতে পুরুষ ও মহিলাদের এক জামাতে কিয়ামুল লাইল আদায়ের ব্যবস্থা করেন। (মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মুআত্তা, আব্দুল হাই লাখনবি, আত-তালিক আল-মুমাজ্জাদসহ পৃ-১/৩৫৫; ইবনে আবি শাইবা; আল-মুসান্নাফ-২/২২২)

বেশির ভাগ মানুষ জামাতে কিয়ামুল লাইল আদায় করতে থাকেন। তবে অনেক সাহাবি, তাবেয়ি ও যারা ভালো হাফেজ ও আবিদ ছিলেন তারা সালাতুল ইশার পর অথবা মধ্যরাতে ও শেষ রাতে একাকী রমজানের কিয়ামুল লাইল আদায় করতেন। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত আছে- রাসূলুল্লাহ সা: স্বয়ং সাহাবিদেরকে নিয়ে কয়েক দিন রমজানের এই বিশেষ সালাত তথা তারাবিহ সালাত পড়েছেন। (বুখারি-২০১২)

রাসূল সা: থেকে সহিহ সনদে ওই রাতগুলোর তারাবির রাকাত সংখ্যা নিয়ে কোনো হাদিস বর্ণিত নেই। মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে ইবনে আব্বাস থেকে রাসূল সা: ২০ রাকাত পড়েছেন মর্মে যে হাদিসটি বর্ণিত আছে তা সর্বাক্যমতে দুর্বল। কারণ ওই হাদিসের সনদে আবু শাইবা ইবরাহিম ইবনে উসমান নামে একজন রাবি আছেন যাকে ইমাম আহমাদ, বুখারি, আবু দাউদসহ সব মুহাদ্দিস দুর্বল কিংবা মাতরুক (পরিত্যক্ত) বলেছেন। (দেখুন, তাহজিবুত তাহজিব, ১/১২৫, তরজামা-২৫৭)

সহিহ হাদিসে প্রমাণিত, রাতের সালাতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর রাকাত সংখ্যা বিভিন্ন রকম ছিল। আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান হজরত আয়েশা রা:-কে জিজ্ঞাসা করেন, রমজান মাসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, তিনি রমজান ও অন্য সময়ে ১১ রাকাতের বেশি বাড়াতেন না। তিনি প্রথমে চার রাকাত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতায় বিস্মিত হবে। এরপর আবার চার রাকাত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতায় বিস্মিত হবে। এরপর তিন রাকাত পড়তেন।

(বুখারি-২০১৩) হজরত আয়েশা রা: থেকে অন্য বর্ণনায় আছে- হজরত আয়েশা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: রাত্রে ৯ রাকাত পড়তেন। (জামে তিরমিজি-৪৪৩) হাদিসটি সহিহ। ইমাম তিরমিজি বলেছেন, হাসান সহিহ আর শাইখ আলবানি বলেছেন, সহিহ। আয়েশা রা: থেকে আরেক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সা: কোনো কারণে রাতে সালাত না পড়তে পারলে দিনেরবেলা ১২ রাকাত পড়তেন। (জামে তিরমিজি-৪৪৫) হাদিসটি সহিহ। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: রাতে ১৩ রাকাত সালাত পড়তেন। (জামে তিরমিজি-৪৪২) হাদিসটি সহিহ। বর্ণনা বিভিন্ন প্রকার হওয়ার কারণে ইমাম তিরমিজি বলেছেন, রাতের সালাতের ব্যাপারে নবী সা: থেকে যা বর্ণনা করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো বিতরসহ ১৩ রাকাত আর সবচেয়ে কম হলো ৯ রাকাত।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, রাতের সালাত, রমজান মাসে হোক কিংবা অন্য সময় হোক রাসূলুল্লাহ সা: রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট করেননি।

সাহাবিদের থেকেও তারাবির রাকাত সংখ্যা নিয়ে বর্ণনাগুলোর মধ্যে ভিন্নতা আছে। হজরত উমার রা: থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত আছে, তার সময়ে লোকেরা মসজিদে জামাতের সাথে ২০ রাকাত সালাত আদায় করেছেন। ইমাম নববী, বদরুদ্দিন আইনি, আল্লামা জাইলায়ি, ইবনে হুমাম প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। শাইখ আলবানি ও আব্দুর রহমান মুবারকপুরী বলেছেন হাদিসটি সহিহ নয়। তাদের কথা- ইলমের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এই হাদিসটির বক্তব্যকে সমর্থন করে অনেক দুর্বল ও সনদবিচ্ছিন্ন হাদিস।

এভাবে আমরা দেখতে পাই, হজরত উমার রা:-এর যুগ থেকে ২০ রাকাত তারাবিহ সহিহ হাদিসে সাব্যস্ত এবং অনেক দুর্বল হাদিস একে সমর্থন করছে, সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ২০ রাকাত তারাবিহ সুন্নাহসম্মত। সাইব ইবনে ইয়াজিদ থেকে অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে- উমার রা: উবাই ইবনে কাব ও তামিম দারিকে আট রাকাত তারাবিহ পড়ানোর জন্য আদেশ দিয়েছেন। (মুয়াত্তা মালেক-৩০২) হাদিসটির সনদ সহিহ। আলোচনা থেকে স্পষ্ট, সাহাবিরাও মনে করতেন না যে, তারাবির সালাত নির্দিষ্ট। তবে বেশির ভাগ আলেম তারাবিহ সালাত ২০ রাকাত আদায় করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

তারাবি সালাত রাসূলুল্লাহ সা: থেকে সহিহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। যারা বেশি কুরআন পড়তে পারে তারা বাড়িতে একা একা এই সারাত পড়বে। আর তারাবির রাকাত সংখ্যা ২০ হজরত উমার রা: থেকে সহিহ সনদে সাব্যস্ত। আর বেশির ভাগ আলেমও ২০ রাকাতকে সুন্নাত মনে করেন। তবে শাইখ আলবানিসহ কোনো কোনো আলেম আট রাকাতের মত গ্রহণ করেছেন।