সাওম ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। আরবী এ ‘সাওম’ শব্দটি আমাদের দেশে রোযা নামে সমধিক পরিচিত, যা মূলত ফারসী শব্দ। সাওম অর্থ বিরত থাকা। যেহেতু পানাহার ও যৌন সম্পর্ক সাধারণত প্রবৃত্তির লিপ্সা ও খাহেশাতের লালসাকে উদ্দীপ্ত করে তাই ইসলাম এ সাওমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। কিন্তু সাওমের মূল লক্ষ্য ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে হলে, অবশ্যই বৈধ পানাহার ও স্ত্রীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য সব ধরনের পাপাচার ও অপ্রকাশ্য মন্দাচার থেকেও অন্তর ও দেহ তথা সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রক্ষা করতে হবে। এদিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে)
‘যে ব্যক্তি সাওম পালন করতে গিয়ে মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কথা মত কাজ করা এবং মূর্খতা (সুলভ আচরণ) থেকে বিরত থাকলো না, তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ [বুখারী : ১৯০৩; আবূ দাউদ : ২৩৬৪]
জীবন ধারণের স্বার্থেই পানাহার সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা সম্ভব নয়। তাই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মাত্র কয়েক ঘন্টা সাওম পালনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার শিশুদেরকে এর আওতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অক্ষম-বৃদ্ধদের জন্য ‘ফিদয়া’র অবকাশ রাখা হয়েছে। মুসাফির, অসুস্থ ও সন্তান প্রসব, স্তন্যদান ও ঋতুকালে নারীদের প্রতি লক্ষ্য রেখে উযর দূর হওয়ার পর ‘কাযা’র মত বিকল্প রাখা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
‘নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৪-১৮৫}
এদিকে রমযান মাস নির্ধারণের ক্ষেত্রে সৌর পঞ্জিকার স্থলে চন্দ্র পঞ্জিকা গ্রহণ করা হয়েছে। এর সুবিধা হলো, সৌর হিসেবে মৌসুমের পরিবর্তন ও ঋতুর পালাবদল হয় না। তেমনি এর দিন-রাতের আকারেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন বা ব্যত্যয় দেখা যায় না। তাই যদি সৌরবর্ষের হিসেবে সাওম পালন করতে হত, তখন যদি কোনো দেশে গ্রীষ্মকালে সাওম পালন করা হত, তাহলে সেখানে সর্বদাই রমযান আসত গ্রীষ্মকালে আর কোথাও শীতকালে রমযান হলে সবসময় শীতকালেই রমযান আসতো। পক্ষান্তরে চন্দ্রমাস এর ব্যতিক্রম। এর মৌসুম বছরে বছরে বদলাতে থাকে আর দিন-রাতের আয়তনও কম-বেশি হয়। এভাবে সাওমের মাস প্রতি দেশে বছর ভেদে প্রতি ঋতুতেই আগমন করে। ফলে সবাই এর মিঠে-কড়া উভয় রূপই উপভোগ করতে পারে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত কিংবা বড় আকারের দিন ও ছোট আকারের দিন প্রভৃতি সব রকম অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে।
ইসলাম ধর্মে সিয়াম সাধনার বিধান রাখা হয়েছে আল্লাহভীতি সৃষ্টি ও তাকওয়া চর্চার উদ্দেশে। কুরআন কারীমে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে- সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।’ {সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩}
আর তাকওয়া হলো মনের ওই অবস্থা যার প্রেরণায় পাপের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড বিরাগ ও পুণ্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পশুসূলভ প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সাধারণত দুর্বল ও কমজোর হয়ে পড়ে, তাই রমযানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে স্বতস্ফূর্তভাবে তাকওয়ার হালত বা আল্লাহভীতির অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।
এ ছাড়া রমযানুল মুবারকে তারাবীহর সালাতের সৌজন্যে আল-কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত বেড়ে যায়। সাওম পালনের উদ্দেশ্যে অভুক্ত থাকার প্রভাবে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও কল্যাণকামিতার মানসিকতা প্রবল হয়। সাওম ও নিছক উপবাসের মধ্যে ব্যবধান তৈরির মানসে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জামাআতের সাথে সালাত আদায়ে পুরুষদের এবং মুস্তাহাব ওয়াক্তে উত্তমরূপে সালাত আদায়ে মহিলাদের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। যিকর-ফিকর, আল্লাহর ইয়াদ ও তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা ও ইস্তিগফার, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ এবং কুরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথে যদি মরণ, কবর জীবন ও পরকালের অবশ্যম্ভাবী অবস্থাদির কথাও স্মরণ করা হয় তবে তো সোনায় সোহাগা<
সিনাই পর্বতে তাওরাত আনতে গিয়ে নবী মুসা আলাইহিস সালাম চল্লিশদিন পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত ছিলেন। সায়ির পর্বতে হযরত ঈসার আলাইহিস সালামের ওপর যখন ইনজিল নাযিল হয়, তার আগে তিনিও চল্লিশদিন পর্যন্ত সাওম অবস্থায় কাটান