যেসব জায়গায় জুমার নামাজ শুদ্ধ হয় নাঅজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর
No icon

আরবে ইসলামপূর্ব জাহেলি নীতি ও মহানবী সা:

ইসলাম আগমনের আগে এই পৃথিবী ছিল জুলুম-অত্যাচার, হত্যা-লুণ্ঠন, ব্যভিচার-মাদক ও সঙ্ঘাতপূর্ণ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী। কোথাও শান্তি ও নিরাপত্তার ছোঁয়া ছিল না। শান্তির পরশ পেতে মানুষ উদগ্রীব ছিল। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা মানব মুক্তির দূত হিসেবে নবী করিম সা:কে আসমানি গ্রন্থ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালেন। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ মানবজাতির জন্য হেদায়াত গ্রন্থ। মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সব কিছুই শরিয়তে বর্ণিত আছে। পৃথিবীকে শান্তি ও বসবাসযোগ্য করতে আল্লাহ তায়ালা নবী করিম সা:কে জাহেলি যুগের যাবতীয় আবর্জনা দূর করার আদেশ দিলেন। ঘোষণা করলেন, তবে কি তারা জাহেলি যুগের ফায়সালা লাভ করতে চায়? যারা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফায়সালাদানকারী কে হতে পারে (সূরা মায়িদা- ৫০)?

আল্লাহর আদেশেই নবী সা: ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগের ইসলামবিরোধী সব রীতি-নীতি বাতিল করেছিলেন। ইসলামপূর্ব যুগের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ইসলাম দুই প্রকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কিছু রীতি ছিল মনগড়া ও অযৌক্তিক, জুলুম ও অনাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে যৌক্তিকভাবেই নবী সা: সেসব রীতি নিষিদ্ধ করেছেন। পক্ষান্তরে কতগুলো রীতি-নীতি ছিল ন্যায়সঙ্গত ও মানবতার সমর্থক, সেগুলোর প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। কিছু জাহেলি নীতি, যেগুলো ইসলাম পরিপূর্ণ বাতিল করেছে।
ক. সর্বপ্রকার শিরক ও কুফরি কর্মকাণ্ড। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতযোগ্য ধারণা করা। জাহেলি যুগের মানুষরা সর্বস্তরে অসংখ্য জীব-জড়কে ইবাদতযোগ্য বলে আকিদা পোষণ করত। যদিও এই আকিদা সরাসরি কুফরি। কিন্তু প্রথা হিসেবে জনারণ্যে এসব কুফরি আকিদা বিস্তার লাভ করেছিল। আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের ঘোষণা করে নবী সা: জাহেলি যুগের এসব ভ্রান্ত আকিদা বাতিল করেছিলেন।
খ. জাহেলি যুগের মানুষ তারকারাজির কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করত। এই প্রথা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। অথচ বিষয়টি বড় প্রকারের শিরক। এতে আল্লাহর জায়গায় তারকাকে বসিয়ে দেয়া হয়। তারকাকে সৃষ্টিকর্তা ও দাতা হিসেবে মান্য করা হয়। অথচ বৃষ্টি দেয়া, না দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই। ফলে নবী সা: এই প্রথা ও মনোভাবকে বাতিল ঘোষণা করেন।
গ. বংশ কৌলিন্য, রূপ-সৌন্দর্য ও গোঁড়া অহমিকা প্রদর্শন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, নিজ ঘরে অবস্থান করো, সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেরিও না, যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো (সূরা আহজাব-৩৩)।

কাফেররা যখন তাদের অন্তরে অহমিকাকে স্থান দিলো যা ছিল জাহেলি যুগের অহমিকা (সূরা ফাতহ-২৬)।

এ আয়াত অবতীর্ণ হলে নবী সা: এসব কঠোরভাবে নিষেধ করেন।
ঘ. বংশে অপবাদ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম কান্নাকাটি করা। নবী করিম সা: বলেছেন, মানুষের ভেতর দুটি বিষয় এমন রয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ কুফরে জড়িয়ে পড়ে। কারো বংশ সম্পর্কে অপবাদ আরোপ এবং মৃত ব্যক্তির জন্য কৃত্রিম কান্নাকাটি করা। হাদিস ব্যাখ্যাকারও লিখেছেন, এখানে কুফরিতে জড়িয়ে পড়া বলতে উদ্দেশ্য; এ স্বভাব দুটি ইসলামপূর্ব যুগের এবং কুফরি প্রথা। ইসলামে বংশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৃত ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করাও ইসলামে পরিপূর্ণ নিষেধ।
ঙ. জাহেলি যুগে গোত্রপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতি ছিল ন্যায়-অন্যায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। নিজ গোত্রের লোকেরা অপরাধ করলেও তারা অপরাধী স্বজনের পক্ষাবলম্বন করত। একেই ইসলাম সাম্প্রদায়িক চরমপন্থা রূপে সাব্যস্ত করেছে। নবী সা: যেকোনো প্রকারের অন্যায়, বংশপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতিকে শক্ত হাতে প্রতিহত করেছেন। বলেছেন, হে মুসলমান সম্প্র্রদায়! আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকাবস্থায় তোমরা জাহেলি যুগের আচরণ করছ (ফাতহুল কাদির-১/৫৪৮)?
চ. কিছু বর্বর রীতি। যেমন কন্যাসন্তান জীবন্ত কবর দেয়া। অভাবের আশঙ্কায় সন্তান জন্মদান না করা, ধোঁকাপূর্ণ লটারি ইত্যাদি। ইসলাম এসব সমূলে উৎখাত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, দারিদ্র্যের কারণে তোমরা নিজ সন্তানদের হত্যা করো না (সূরা আনআম-১৫১)।
ছ. জাহেলি কিছু দণ্ডবিধি যেমন জাহেলি যুগে ক্ষমতাবানরা দুর্বলের ওপর দ্বিগুণ দণ্ড আরোপ করত, পক্ষান্তরে নিজেরা দুর্বলদের দিত সামান্য। শক্তিশালীদের একজনের বিনিময়ে দুর্বলদের ১০ জনকে হত্যা করা হতো, কিন্তু দুর্বলদের একজনের বিনিময়ে সবলদের একজনকেই হত্যা করা হতো।
জ. জাহেলি যুগে ইলার (স্বামী স্ত্রীর সাথে সঙ্গম না করার শপথ) মেয়াদ ছিল এক-দুই বছর। ইসলাম এসে ইলার মেয়াদ ঘোষণা করে চার মাস। এরপর স্বামী স্ত্রীকে হয় বিয়ে করে কাফফারা দেবে, না হয় বাদশাহ তাকে তালাক বা ফায় দিতে বাধ্য করবেন।
ঝ. চক্রবৃদ্ধি হারে জাহেলি যুগের সুদখোররা সুদ গ্রহণ করত। ইসলাম এসে সর্বপ্রকার সুদকে হারাম করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম(সূরা বাকারা-২৭৫)।

ঞ. জাহেলি যুগে কুরাইশ ও তাদের সমমনারা হুমুস নিজেদের মর্যাদা প্রদর্শন করতে হজের মৌসুমে মুজদালিফায় অবস্থান করত। আর অন্যদেরকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে বাধ্য করত, মুজদালিফায় আসতে দিত না। ইসলাম এসে সবাইকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে জাহেলি অন্যায় প্রথা বাতিল করে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা সেই স্থান (সবাই একসাথে আরাফার ময়দানে অবস্থান করে সেখান) থেকেই রওনা হবে, যেখান থেকে অন্যরা রওনা হয়(সূরা বাকারা-১৯৯)।

 জাহেলি যুগের আরো অনেক রীতি রয়েছে, লোকেরা যত উপকার আর কল্যাণ বর্ণনা করুক না কেন, শরিয়ত ও মানবস্বভাববিরোধী হওয়ার কারণে ইসলাম এসব নীতি সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছে। যেমন মদপান, ব্যভিচার, চুরি, জুয়া, ধোঁকা ও জ্যোতির্বিদ্যা। পাশাপাশি জাহেলি যুগের কিছু বিষয়কে ইসলাম গ্রহণ করেছে। মানুষকে এসবের ওপর আমল করতে আহ্বান জানিয়েছে। যেমন দয়া করা, অতিথিকে সম্মান করা, দুর্বলের উপকার করা, মানবসেবা করা, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা, রক্তপণ অতিথিকে সম্মান করা ইত্যাদি।