ইস্তাম্বুল শহরের আইয়ুব অঞ্চলে অবস্থিত আইয়ুব সুলতান মসজিদ খুবই বিখ্যাত। ১৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ আল-ফাতিহের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী কনস্টান্টিনোপল বিজয় করে। বিজয়ের পাঁচ বছর পর তৈরি হওয়া এ মসজিদকে ইস্তাম্বুল শহরে মুসলিমদের তৈরি করা প্রথম মসজিদ মনে করা হয়। মূলত বিখ্যাত সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর সমাধিস্থল অক্ষুণ্ন রাখতে তাঁর নামে এর পাশে একটি মসজিদ করা হয়। এখানে আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-সহ অনেকের কবর রয়েছে।
৫৪ হিজরি (৬৬৮-৬৭০ খ্রি.) কনস্টান্টিনোপল বিজয় করতে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন সৈনিক হিসেবে এসে আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৭০০ বছর পর বিশাল শহর বিজয়ের পর সুলতার আল-ফাতিহের আধ্যাত্মিক গুরু শায়খ আক শামসুদ্দিন কবরটি অনুসন্ধান করে বের করেন। আর পাশেই তাঁর নামে মসজিদটি করা হয়। তুর্কিরা বিখ্যাত এই সাহাবির সম্মানার্থে এর নাম রাখেন আইয়ুব সুলতান মসজিদ।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসির আল-জাজারি (রহ.) তাঁর উসদুল গাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবা গ্রন্থে লিখেছেন, আবু আইয়ুব আল-আনসারি (রা.)-এর মূল নাম খালিদ বিন জায়েদ বিন কুলাইব। তিনি খাজরাজ গোত্রের সদস্য ছিলেন। রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পর তাঁর ঘরের অতিথি হিসেবে এক মাস অবস্থান করেন। আকাবার শপথ, বদর যুদ্ধসহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। সিয়ারু আলামিন নুবালা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া (রা.)-এর নেতৃত্বে অবরোধ করে কনস্টান্টিনোপল শহর জয়ের চেষ্টা করা হয়। তখন আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-কে দেখতে আসেন সেনাপতি ইয়াজিদ। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আপনার কী প্রয়োজন? তখন আবু আইয়ুব (রা.) বলেন, আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে বহন করে নিয়ে যাবে।
অতঃপর শত্রুর ভূমিতে আমাকে দাফন করবে এবং ফিরে যাবে। তিনি মারা গেলে কনস্টান্টিনোপল শহরের প্রাচীরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। পরদিন রোমান সেনারা মুসলিম বাহিনীকে জিজ্ঞেস করে, ‘হে আরব জাতি, রাতের বেলা তোমাদের কী হয়েছিল? তখন তারা উত্তর দেয়, আমাদের নবী (সা.)-এর একজন বড় সাহাবি মারা গেছেন। আল্লাহর শপথ, তাঁর কবর খোঁড়া হলে পুরো আরব অঞ্চলে ঘণ্টা বাজানো হবে।
১৪৫৩ সালে সুলতান কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর সমাধিটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে পড়ে। কারণ এ মসজিদেই উসমানীয় সুলতানদের ক্ষমতা গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতো। এখানে উসমান বিন আর্তুগরুলের তরবারি স্পর্শ করে সুলতানরা মুকুট পরিধান করতেন। তা ছাড়া তুর্কিদের কাছেও রাসুল (সা.)-এর মেজবান এ সাহাবির বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাই অনেক আগে থেকে স্থানীয়দের সবাই এই স্থানকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পর্যটক স্থানটি দর্শনে যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এরদোয়ান যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর বিখ্যাত এই সাহাবির কবর জিয়ারত করেন এবং এই মসজিদে নামাজ পড়েন। বিশেষত জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ এবং ২০১৬ সালে অভ্যুত্থানচেষ্টার পর থেকে তিনি নিয়মিত এই সাহাবির কবর জিয়ারত করেন।
আবু আইয়ুব মসজিদ ঘিরে একটি মাদরাসা স্থাপন করা হয়। সেখানে দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থীরা এসে পড়াশোনা করত। এখানে থাকা ও খাওয়ার জন্য তাদের কোনো ব্যয় করতে হতো না। তা ছাড়া এখানে দরিদ্রদের খাবারের ব্যবস্থাও ছিল। মসজিদের সামনে রয়েছে প্রাচীন একটি গাছ। মনে করা হয়, এটি শহর বিজয়ের আগ থেকেই এখানে রয়েছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে আশপাশে বিশাল শহর-নগর বিনির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হলে মসজিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন সুলতান তৃতীয় সেলিম মসজিদের সব স্থাপনা ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন হয়। সর্বশেষ তুরস্কের বর্তমানে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের শাসনকালে মসজিদটি পুনরায় সংস্কার করা হয়। ২০১১ সালে মসজিদটির সংস্কারকাজ শুরু হয়, যা ২০১৫ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হয়। এর পর থেকে তা সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। জুমার নামাজ ছাড়াও এখানে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে মানুষের ভিড় থাকে।
তথ্যসূত্র : আলজাজিরা