অজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতরবৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর
No icon

গাউসুল আজম বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ:

১১ রবিউস সানী, ফাতেহায়ে ইয়াজদাহাম। বড়পীর গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর ওফাত দিবস। জগত বিখ্যাত এ মহান ওলী ৪৭০ হিজরীর রামাদান মাসে পারস্যের জিলানে জন্মগ্রহণ করেন। জিলান শহরকে আরবীতে "কিলান"ও বলা হয়। তার পিতা হলেন সায়্যিদ আবু সালেহ মূসা জিংকী রহ:। তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ট বুযুর্গ, যাহিদ, আল্লাহওয়ালা ছিলেন। তার দুনিয়া বিরাগ সবার মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল। হযরত বড়পীর দস্তগীর রহ: এর মায়ের নাম সায়্যিদা উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহ:। পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই বড়পীর রহ: নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের ছিলেন। পিতার দিক থেকে তিনি হযরত ইমাম হাসান রা. এর বংশধর আর মায়ের দিক থেকে ইমাম হুসাইন রা. এর বংশধর (নাজীবুত তারফাইন)। 

গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: যে সময়ে এ পৃথিবীতে আসেন সে সময়ে পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। একদিকে গ্রীক ও পাশ্চাত্য দর্শনের বিভ্রান্তিতে মুসলমানরা তাওহীদ থেকে সটকে পরার উপক্রম। অন্যদিকে মুসলিম রাজ্যগুলো ধ্বংস করার জন্য মোঙ্গল ও ক্রুসেডদের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা। মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা একজন মুজাদ্দিদের (দ্বীন সংস্কারক) প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।

মুসলিম মিল্লাতের এক কঠিন সময়ে বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর জন্ম হয়। তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দ্বীন ইসলামকে পুনর্জীবন দান করেন। এ জন্য বড়পীর রহ: কে " মুহিউদ্দীন" (দ্বীন পুনর্জীবিতকারি) বলা হয়।

শিশু অবস্থায় হযরত বড়পীর রহ: এর অলৌকিক বিষয় তার বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে এসেছে। তা হলো— তিনি রামাদান মাসে দিনের বেলা তার মায়ের দুধ পান করতেন না। বরং ইফতারের সময়ের পর তিনি দুধ পান করতেন। (সূত্র: আত তিরাযুল মুযাহহাব ফি মাওলিদিল বাযিল আশহাব) বাল্যকালেই বড়পীর রহ: তাঁর বুযুর্গ পিতাকে হারান। তার পিতৃবিয়োগের কারণে তিনি মমতাময়ী মা এবং নানা সায়্যিদ আব্দুলাহ আস সাউমাঈ রহ: এর তত্ত্বাবধানে বড় হন। তার নানা সে সময়ের অন্যতম বুযুর্গ আল্লাহওয়ালা ছিলেন।

গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: নানাজান সায়্যিদ আব্দুল্লাহ আস সাুমাঈ'র কাছে কুরআন কারীম হিফয করেন এবং আরবী ভাষা ও ফিকহের প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। জিলানের আলেম উলামার কাছ থেকেও জ্ঞানার্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি বাগদাদে গিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছা করেন। কারণ সে সময়ে বাগদাদ ছিল ইলমের রাজধানী। দুনিয়ার বড় বড় আলেম উলামাকে বাগদাদ শহর স্বাগতম জানাতো। বড়পীর রহ: বাগদাদে যাওয়ার ইচ্ছা হলে তার মমতাময়ী মাকে অবগত করেন। তখন তার মায়ের বয়স ছিল ৭০ বছর এবং তার বয়স ছিল ১৮ বছর। সায়্যিদাহ ফাতিমা রহ: তাকে বাগদাদ যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। বড়পীর রহ: মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় তার মা জননী তাকে ৪০ দিনার (স্বর্ণমূদ্রা) প্রদান করেন এবং বিভিন্ন নসীহত করেন। বাগদাদ যাওয়ার পথে তারা একদল ডাকাতের আক্রমণের স্বীকার হন। এ ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। বড়পীর রহ: এর সত্যবাদিতার কারণে ডাকাতদল তাওবাহ করে দ্বীনের পথে ফিরে আসে।

৪৮৮ হিজরীতে (১০৯৫ খৃস্টাব্দ) বড়পীর রহ: বাগদাদ প্রবেশ করেন। তখন মুসলিম বিশ্বের শাসনকার্যে ছিলেন আব্বাসীয় খলীফা মুসতাজহার বিল্লাহ। বাগদাদ পৌঁছে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ: তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-এ-নিযামিয়ায় ভর্তি হন এবং সে সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান তাপসদের তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যেই ইলেম শারীআত, ইলেম লুগাত, ইলেম ফিক্হ, ইলেম তাফসির, ইলেম কিরাআত, ইলমে তাসাউফসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বাগদাদে বড়পীর রহ: এর উস্তাদগণের মধ্যে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি ছিল। বড়পীর রহ: নিজেও হাম্বলী মাযহাব অনুসরণ করতেন। তবে তিনি হাম্বলী ও শাফেঈ— উভয় মাযহাবের মুফতী। এ বিষয়ে ইমাম নববী রহ: বলেন, (বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ:) তিনি বাগদাদে শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবদ্বয়ের ফকীহ ছিলেন।

বড়পীর রহ: এর ইলমী গভীরতা খুব বেশি ছিল। সমকালীন আলেমগণ তার দারসে বসে উপকৃত হতেন। ইমাম আব্দুল ওয়াহাব শা'রানী রহ: বলেন, শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী রহ: জ্ঞানের ১৩ টি শাখা নিয়ে কথা বলতেন। ছাত্ররা তার মাদরাসায় তার কাছে তাফসীর, হাদীস, ইলমে ফিকহ, ইখতিলাফী মাসাইল অধ্যয়ন করত। সকাল সন্ধা তিনি তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসুল, নাহু এগুলো পড়াতেন। যুহরের পর তাজবীদসহ কুরআন কারীম পড়াতেন। তিনি শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের আলোকে ফতওয়া দিতেন। (সূত্র: আত তাবাকাতুল কুবরা)।

বড়পীর রহ: এর জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে তার ছাত্র ইবনু কুদামাহ বলেন, আমি ৫৬১ হিজরীতে বাগদাদে প্রবেশ করি। আমি লক্ষ্য করলাম ইলম, আমল, ফতওয়া সবকিছুর দৌড় আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর কাছে গিয়ে শেষ হয়। তার দারসে যারা বসেছে তাদেরকে ইলম অর্জনের জন্য আর কোথাও যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তাআলা তাকে অনেক গুণাবলি দান করেছেন। আমি তার সমতুল্য আর কাউকে পাই নি।

গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: বাগদাদে ইলমে জাহির অর্জনের পাশাপাশি ইলমে বাতিন তথা ইলমে তাসাওউফও অর্জন করেন। ইলমে তাসাওউফের তা'লিম নেওয়ার জন্য বড়পীর রহ: প্রথমে বায়আত হন বাগদাদের বিখ্যাত সূফী আবু মুহাম্মদ আদ-দাব্বাস রহ: এর কাছে। পরবর্তীতে বায়আত হন হযরত আবূ সাঈদ মাখযুমী (অথবা মুখাররিমী) রহ: এর কাছে। আল্লাহ তাআলা পাওয়ার এই দীর্ঘ পথে বড়পীর রহ: কঠোর রিয়াজত মেহনত করেন। জনমানবহীন জঙ্গলে গিয়ে আল্লাহ মুরাকাবাহ মুশাহাদা, যিকর আযকারে ব্যস্ত থাকতেন। তার রিয়াজত মেহনতের সময়ে তিনি দুনিয়ার যাবতীয় আরাম আয়েশকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আহার-নিদ্রা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাকে না খেয়েও থাকতে হয়েছে। একসময় ক্ষুধার তাড়নায় তিনি গাছের পাতাও খেয়েছেন। এগুলোর তার রিয়াজতের অংশ ছিল, আবার সে সময়ে বাগদাদে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছিল। দুনিয়ার ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করে কামালাতের উচ্চ মাকামে পৌছতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর রাতজেগে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে সময় কাটিয়েছেন। কামালাত অর্জনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রহ: তাকে তাসাওউফের সনদ এবং খিরকা (জুব্বা) প্রদান করেন।

৫০১ হিজরীতে হযরত আবু সাঈদ মাখযুমী রহ: বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ: কে তার মাদরাসায় ওয়াজ করার জন্য বলেন। বড়পীর রহ: সেখানে সপ্তাহে তিনদিন বয়ান পেশ করতেন। তার বয়ান এতো হৃদয়গ্রাহী ছিল যে সেখানে আমীর উমারা সহ সর্বস্তরের মানুষ সেখানে উপস্থিত হতেন। এমনকি তার বয়ান শুনার জন্য বিধর্মীরাও উপস্থিত হতেন এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করতেন। পীর ও মুরশিদ শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী রহ: এর ইন্তেকাল হলে তার মাদরাসার দায়িত্ব এসে পড়ে বড়পীর রহ: এর কাছে। তিনি মাদরাসার দারস-তাদরীস ও ফতওয়ার আসন অলংকৃত করেন।

গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রহ: তার তাফসীর, হাদীস, তাসাওউফ সহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কিতাব লিখেছেন। তার প্রসিদ্ধ কয়েকটি কিতাব হলো— গুনিয়াতুত তালিবীন, ফুতুহুল গায়ব, সিররুল আসরার, তাফসীরে জিলানী, ফুতুহাতুর রাব্বানিয়্যাহ, আর রিসালাহ আল গাউসিয়্যাহ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি কিতাব বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।

বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর কারামত সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কিরামের বক্তব্য হলো— শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী রহ: এর কারামত মুতাওয়াতির পর্যায়ের। যা অন্য কোন বুযুর্গের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আল্লামা দামিরী রহ:, ইমাম যাহাবী র. এর মতো বিখ্যাত ইমামগণ তার কারামত বর্ণনা করেছেন। তবে তার নামে সমাজে কিছু ভুয়া বানানো কারামাত প্রচার করা হয়। এগুলো থেকেও সতর্ক থাকা জরুরী। "কালাইদুল জাওয়াহির" কিতাবের লেখক বলেন, বড়পীর র. এর থেকে অধিক কারামত প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে আলেমগণ একমত। তার বড় একটি কারামত হলো তার ফায়য ও তাওয়াজ্জুহর বদৌলতে যেকোনো মৃত কলব জীবিত হয়ে যেত। এ জন্য তার প্রত্যেক মজলিসেই ইয়াহুদী নাসারা সহ অন্যান্য বিধর্মীরা মুসলমান হতো।

সারা জীবন মালিক ও মওলার আনুগত্য এবং ইবাদতে অতিবাহিত করে ৫৬১ হিজরীর রবিউস সানীতে বড়পীর রহ: ইন্তেকাল করেন। বাগদাদে তার মাদরাসার পাশেই তাকে দাফন করা হয়। তার মাজারকে কেন্দ্র করে হাজারো মুমিন তাদের আত্মার প্রশান্তি খুঁজে নেয়।

বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: সম্পর্কে ইমাম আব্দুল ওয়াহহাব শা'রানী রহ: তার আত তাবাকাতে উল্লেখ করেন
হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী র. অপেক্ষা অধিক উত্তম চরিত্রবান, উদার মানসিকতাসম্পন্ন, দয়ালু, নম্র-ভদ্র, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী আমি আর কাউকে দেখিনি। উচ্চ মর্যাদা ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছোটদের সাথে ছিলেন স্নেহপরায়ন এবং বড়দের সাথে ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তিনি সবার আগে সালাম দিতেন, দুর্বল অসহায় লোকদের সাথে উঠা বসা করতেন এবং তাদের সাথে বিনয়-নম্র ব্যবহার করতেন। তিনি নেতৃস্থানীয় কোন লোক বা শাসকশ্রেণীর কোন ব্যক্তির সম্মানের জন্য কোন দিন দাঁড়াননি এবং তাদের দরজায় কোন দিন যাননি।

বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী র. মুহযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী র. অপেক্ষা অধিক উত্তম চরিত্রবান, উদার মানসিকতাসম্পন্ন, দয়ালু, নম্র-ভদ্র, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী আমি আর কাউকে দেখিনি। উচ্চ মর্যাদা ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছোটদের সাথে ছিলেন স্নেহপরায়ন এবং বড়দের সাথে ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তিনি সবার আগে সালাম দিতেন, দুর্বল অসহায় লোকদের সাথে উঠা বসা করতেন এবং তাদের সাথে বিনয়-নম্র ব্যবহার করতেন। তিনি নেতৃস্থানীয় কোন লোক বা শাসকশ্রেণীর কোন ব্যক্তির সম্মানের জন্য কোন দিন দাঁড়াননি এবং তাদের দরজায় কোন দিন যাননি। বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী র. মুস্তাজাবুদ দাওয়াত (যার দুআ সর্বদা কবুল করা হয়) ছিলেন। সব সময় চিন্তা ফিকিরে মশগুল থাকতেন। ইবাদত বন্দেগীর জন্য তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তার বয়ান শুনলে মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তো