খুশু-খুজু বা বিনয় ও নম্রতা হচ্ছে নামাজের প্রাণ। নামাজের যাবতীয় ফজিলত, প্রভাব ও উপকারিতা এই খুশু-খুজুর সাথেই সম্পৃক্ত। খুশু-খুজুর সাথে নামাজ আদায় করলে তা সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়। আর খুশু-খুজুবিহীন নামাজ প্রাণহীন-আত্মাহীন লাশের মতো। তাই নামাজে খুশু-খুজু অবলম্বন করা একজন মুমিন বান্দার জন্য একান্ত আবশ্যক।
খুশু-খুজুর কি? : ‘খুশু’ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- একাগ্রতা, বিনয় ও নম্রতা। পরিভাষায় ‘খুশু’ শব্দটির দু’টি অর্থ রয়েছে। যথা- ১. বিনয় ও নম্রতা এবং ২. শান্ত ও স্থিরতা। অন্তরে খুশু বলতে এই উভয় অর্থকেই বোঝায়। আর ‘খুজু’ শব্দটি দৈহিক ও বাহ্যিক বিনয় ও নম্রতাকে বোঝায়। ইসলামী পরিভাষায় খুশু বলতে পরিপূর্ণ বিনয়, নম্রতা ও গভীর মনোযোগের সাথে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে বোঝায়। খুশুর সম্পর্ক অন্তরের সাথে। মূলত অন্তরের খুশুই আসল খুশু। কারণ, অন্তরে যখন খুশু তথা আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভয়-ভীতি, বিনয় ও নম্রতা সৃষ্টি হবে, তখন মানুষের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ খুজু নির্ভর করবে খুশুর ওপর। ওয়াসওয়াসা কিংবা অন্য মনষ্কতার দরুন খুশুতে বিঘœতার ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইবাদতেও বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়।
আল্লামা সাআদি রহ: বলেন, ‘নামাজে খুশুর অর্থ হলো- মহান আল্লাহর সান্নিধ্যের অনুভূতি নিয়ে এ কাগ্র হৃদয়ে তাঁর সামনে দণ্ডায়মান হওয়া। এর মাধ্যমে বান্দার অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। তা ছাড়া এতে অবাঞ্ছিত নড়াচড়া বন্ধ হয় এবং দৃষ্টি অবনত হয়। নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু আদায় পাঠ করা হয়, আদবের সাথে তার রবের সামনে দাঁড়িয়ে সেগুলোর প্রতি ধ্যান থাকে। এর মাধ্যমে নফসের কুচিন্তা ও শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। আর এটিই নামাজের রূহ বা প্রাণ এবং নামাজের মূল উদ্দেশ্য।’ (তাফসির সাআদি, পৃষ্ঠা-১/৫৪৭) ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ: নামাজের খুশুকে শরীরের আত্মার সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘শরীর থেকে যখন আত্মা চলে যায়, তখন তা মৃত্যুবরণ করে। একইভাবে নামাজে খুশু না থাকলে এটি তার প্রাণ, রূহ ও আত্মা হারিয়ে ফেলে। খুশু ছাড়া নামাজ আদায় করা রাজাকে মৃত খাদেম উপহার দেয়ার মতো।’ এরপর তিনি বলেন, ‘এভাবে নামাজ আদায় করলে যদিও নামাজের আবশ্যকীয়তা পালন করা হয়; কিন্তু এ ধরনের নামাজ আল্লাহ কবুল করেন না, এর জন্য পুরস্কৃতও করেন না।’
নামাজে খুশু-খুজুর গুরুত্ব : ইসলামী শরিয়তে খুশুর গুরুত্ব অপরিসীম। খুশু বা একাগ্রতা নামাজের প্রাণ। ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য খুশু তথা একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই। একাগ্রতাবিহীন নামাজ দায়সারা ও শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ব্যতীত তেমন কিছুই বয়ে আনে না। আল্লাহর কাছে এমন নামাজের মূল্য নেই। এসব নামাজির আল্লাহ তায়ালা নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন এবং শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন।’ (সূরা আল মাউন : ৪-৫)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির রহ: বলেন, তারা নামাজের ব্যাপারে উদাসীন। অর্থাৎ প্রথম ওয়াক্তে নামাজ না পড়ে অধিকাংশ সময় শেষ ওয়াক্তে নামাজ পড়ে। অথবা উদ্দেশ্য হলো- নামাজের রুকন, শর্ত, ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাহগুলো আদায়ের ব্যাপারে অলসতা দেখায় এবং যেভাবে আদেশ করা হয়েছে সেভাবে আদায় করে না। আরেকটি ব্যাখ্যাও এমন হতে পারে যে, তারা নামাজের মধ্যে মনোযোগ ঠিক রাখে না, আল্লাহ তায়ালার কাছে সমর্পিত হয় না এবং নামাজের মুহূর্ত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। মোটকথা ‘উদাসীন’ শব্দটি প্রতিটি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। উপরোল্লিখিত যে কাজটি কেউ করবে সে এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। আর যার মধ্যে সবগুলোই পাওয়া যাবে, সে এই আয়াতের পরিপূর্ণ প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বাস্তবিক ক্ষেত্রেই নিফাক ও কপটতা পূর্ণাঙ্গরূপে তার মধ্যে প্রকাশ পাবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির-৮/৪৯৩)