যেসব জায়গায় জুমার নামাজ শুদ্ধ হয় নাঅজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর
No icon

নবী-রাসুলদের ভালোবাসা

আল্লামা ইকবাল ভালোবাসাকে ভুবনজয়ী বলেছেন। ‘ভুবনজয়ী’ শব্দ উচ্চারণ করলে আমাদের মন ও চিন্তা সেসব বিশ্ববিজেতার দিকে চলে যায় নিজেদের শক্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ভূখণ্ড জয় করেছে এবং লাখ লাখ মানুষকে (দেহ) দাসে পরিণত করে রেখেছে। যারা অসংখ্য দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীর মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় করেছে, তাদের ভাষাহীন করেছে, যুক্তি-প্রমাণ ভোঁতা করে দিয়েছে। বহু ধনাঢ্য ব্যক্তি মানুষের মুখে স্বর্ণের মোহর এঁটে দিয়েছে এবং অর্থের লাগাম লাগিয়েছে। ফলে তারা ধনীদের গুণগ্রাহীতে পরিণত হয়েছে। যদিও তাদের বিবেক তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অন্তর তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছে, তবু তাদের জিহ্বা ধনীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আছে।

কিন্তু ভালোবাসার বিজয়টা অন্যসব বিজয় থেকে ভিন্ন, উচ্চতর। এতটাই ভিন্ন যে ভালোবাসার কারণে মানুষকে অক্ষমতা প্রকাশ করতে হয়, মানুষের অধিকার বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কেননা মানুষ তাঁর প্রিয় বস্তু, ভালোবাসার মানুষকে হারাতে হারাতে পায় এবং ভালোবাসার ময়দানে হারতে হারতে মানুষ জিতে যায়। একসময় কোনো স্বজাতিকে, সৃষ্টির সেরা মানুষকে, কোনো হৃদয়বান ব্যক্তিকে, কোনো পাগলপাড়াকে পরাজিত বলতে তারও কষ্ট হয়, সে লজ্জিত হয়। এটা হয় তার মনুষ্যত্বের প্রতি তার অনুরাগ, সূক্ষ্ম আবেগ ও অনুভবের কারণে। রাজা-বাদশাহরা, বিশ্ববিজেতারা, বস্তুগত উপায়-উপকরণের অধিকারীদের বিশ্বাস হলো কোনো ‘বাঁশও থাকবে না, কোনো বাঁশরিও বাজবে না’। কিন্তু ভালোবাসার ধারকদের মূলনীতি হলো ‘বাঁশ থাকবে, তবে বাঁশরি শুধু তার সুর পাল্টে দেবে। আগে সে ঘৃণা ও বিদ্বেষের গান গাইত, এখন সে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার গান গাইবে।’ রাজা-বাদশাহ ও ক্ষমতার চর্চাকারীদের মূলনীতি হলো শত্রুকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। যারা ভালোবাসার ধারক তাদের মূলনীতি হলো শত্রুকে শুধু অনুরাগী নয়; বরং বন্ধুতে পরিণত করা হবে। এই মূলনীতির ফল হলো যে খুনপিয়াসী হয়ে এসেছিল, সে কলেমা পাঠকারী ও জীবনোৎসর্গকারী হিসেবে ফিরে যায়। আল্লাহর নবী-রাসুল (আ.), ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা ও নির্লোভ মানবসেবীদের পথই হলো ভালোবাসার পথ।


আখলাক ও আধ্যাত্মিকতা, তাসাউফ ও সাধনার ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তে ভরপুর যে ব্যক্তি জীবন নিতে এসেছিল কিন্তু নিজেই জীবন ও মন দুটোই দিয়ে বসে আছে। না না আমি ভুল বললাম। সে হারায়নি; বরং সে সব কিছু লাভ করেছে। সে খুঁজে পেয়েছে দৃষ্টির আড়ালে থাকা অভ্যন্তরীণ শোভা ও সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা। প্রতিটি মানুষের ভেতর ভালোবাসার, অন্যকে মূল্য দেওয়ার, অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে সে তা শুধু চিনতে পারেনি; বরং স্বাদ পেয়েছে। ফলে সে সারা জীবন ভালোবাসার স্বাদ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মূলত আগে সে নিজেকে চিনত না, এখন চিনতে পেরেছে। আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘নিজেতে ডুব দিয়ে খুঁজে নাও জীবনের পথ/যদি তুমি আমার না হও, না হলে; নিজের তো হও।’

 

কত মানুষ এমন ছিল, যাদের মন-মস্তিষ্কে সংশয় ও অস্বীকারের গিঁট পড়ে ছিল। দর্শন ও যুক্তি, জ্ঞান ও বুদ্ধি যতই গিট খোলার চেষ্টা করেছে, তাতে আরো বেশি নতুন গিঁট পড়েছে। কিন্তু এসব সহৃদয় ব্যক্তি ও ভালোবাসার ধারকদের একটি অন্তরজয়ী দৃষ্টি, চোখের দীপ্তি ও মুখের হাসি মনের গিঁট ও জটিলতা মুহূর্তের মধ্যে দূর করে দেয়। আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘উভয় জগৎ থেকে অন্তরকে করেছে বিমুখ/আশ্চর্য বিষয় অন্তরের এই পরিতৃপ্তি।’

ভারতবর্ষের বিখ্যাত সুফি ও আধ্যাত্মিক সাধক খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ভালোবাসা ও ব্যক্তিত্ববোধে, আত্মসম্মান ও সচ্চরিত্রে, ক্ষমা ও উপেক্ষা করার মধ্যে কেমন জাদু, কতটা আকর্ষণ, বিজয় ও কবজা করার শক্তি আছে। খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর নিয়ম ছিল, যখন কেউ দেখা করতে আসত সে নিজের সামর্থ্য অনুসারে হাদিয়া (উপহার) নিয়ে আসত। অন্যদিকে নিজামুদ্দিন (রহ.) সাধারণত প্রতিদিন রোজা রাখতেন। এ ছাড়া খাবারের প্রতি তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই উপহার হিসেবে তিনি যা পেতেন তা দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। একবার একজন অতি শিক্ষিত ব্যক্তি দার্শনিক কায়দায় তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড়ে মিশে যান। লোকটি ভাবল, তার কাছে কত মানুষ উপহার নিয়ে আসে। তিনি কিভাবে বুঝবেন, কে কী নিয়ে এলো। লোকটি রাস্তা থেকে এক থলে মাটি তুলে নেয়। অন্যদের উপহার যেখানে রাখা হতো সেখানে মাটির থলেও রেখে দেয়। খাজা নিজামুদ্দিন (রহ.)-এর নিয়ম ছিল সব উপহার একত্র করে তিনি তাঁর বিশেষ সেবক খাজা ইকবাল (রহ.)-কে তা উপযুক্তদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন।

সেদিনও একই নিয়মে খাজা ইকবাল (রহ.) উপহার বণ্টন করে দেন। কিন্তু যখন তিনি মাটির থলে উঠাতে যান নিজামুদ্দিন (রহ.) তাঁকে নিষেধ করে বলেন, এটা রেখে দাও। এটা আমার চোখের সুরমা। কেননা তিনি চিন্তা করেছিলেন যদি রহস্য ফাঁস হয়, তবে শিক্ষিত ব্যক্তির পরিণতি ভালো হবে না। বুজুর্গরা কোনো মানুষের অসম্মান ও অমর্যাদা সহ্য করেন না। মানুষের মন ভাঙা তাদের নীতিবিরুদ্ধ। সেই শিক্ষিত ব্যক্তি খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর ভালোবাসায় পড়ে গেলেন এবং গুণগ্রাহীতে পরিণত হলেন। এই মহান বুজুর্গ বলেন, শত্রুতার প্রতিবিধান শত্রুতা, ঘৃণার প্রতিবিধান ঘৃণা এবং বিদ্বেষের প্রতিবিধান বিদ্বেষ নয়; বরং শত্রুতার প্রতিবিধান বন্ধুত্ব ও শুভ কামনা, ঘৃণার প্রতিবিধান ভালোবাসা, পাপের প্রতিবিধান পুণ্য। তিনি আরো বলেন, কাঁটার বিপরীতে যদি কাঁটাই রেখে দেওয়া হয়, তবে পৃথিবী কাঁটাতে ভরে যাবে। পৃথিবীতে সংকট বেড়ে যাবে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন ভালোবাসার এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। মূলত আল্লাহর কুদরত (বিধান) সর্বদায় এক। আল্লাহ যে জিনিসে যে প্রভাব রেখে দিয়েছেন, হাজার বছর ধরে তা ক্রিয়াশীল। ভালোবাসার পথ এখনো এমনই ফলপ্রসূ। এই পদ্ধতি যতটা কার্যকর, অন্য কোনো পদ্ধতি ততটা নয়।