মৃত্যুর পর থেকেই মানুষের পার্থিব জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে। কিন্তু কেন মানুষকে পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে? উত্তর হলো, আল্লাহ মানবজাতিকে পৃথিবীতে বিশেষ যোগ্যতা, ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে মানবজাতির ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমি আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হলো। কিন্তু মানুষ তা বহন করল; সে অতিশয় অবিচারকারী, অতিশয় মূর্খ। পরিণামে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদের শাস্তি দেবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৭২-৭৩)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আমানত হলো আল্লাহর আনুগত্যের অঙ্গীকার ও তাঁর বিধি-বিধান। যাকে শরিয়ত অর্পিত দায়িত্ব বলা যায়। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, আয়াতে বর্ণিত ‘আমানত’ হলো আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব। মানুষ দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার কারণেই আল্লাহর আনুগত্যের জন্য যেমন পুরস্কার পাবে, তেমনি তাঁর নাফরমানির জন্য শাস্তি পাবে। মহান এই দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যরা অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করে নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য ও সাহসের প্রমাণ দিয়েছে।
উল্লিখিত আয়াতে ব্যবহৃত ‘জালিম’ তথা অবিচারকারী ও জাহেল তথা মূর্খ শব্দদ্বয় মানুষের যোগ্যতার প্রমাণ বহন করে। কেননা জালিম বলা হয় যার সুবিচার করার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জুলুুম করে এবং জাহেল বলা হয় জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা নিয়ে যে ব্যক্তি মূর্খ থাকে। মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রাণী হয়তো আলিম ও আদিল (জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ) হবে। যেমন ফেরেশতারা। অথবা তারা শুধু জালিম ও জাহেল হবে। যেমন পশু-পাখি। ফেরেশতাদের ক্ষুৎপিপাসা, ভয়-ভাবনা, জৈবিক লালসা, রাগ, অহংকার বলতে কিছুই নেই। তাদের জীবন-জীবিকা বা স্বাস্থ্য রক্ষার বালাই নেই। অর্থাৎ জীবজগতের কোনো প্রয়োজনই তাদের নেই। তারা সব প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে থেকে শুধু আসমানি নির্দেশ পালনের অপেক্ষা করে। তাই কোনো নির্দেশ পাওয়ামাত্রই তা বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। পশুর অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। কতশত মন্দ স্বভাব পশুদের ভেতর বিদ্যমান। তারা জৈবিক আনন্দ ছাড়া কিছুই বোঝে না। ফলে তারা স্বার্থ, ভোগ-লালসা ও উত্তেজনার উত্তাল তরঙ্গে ডুবে থাকে।
অন্যদিকে আল্লাহ মানুষের ভেতর সম্পূর্ণ বিরোধী দুটি শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছেন।
এক. ফেরেশতা প্রকৃতি তথা বিবেকবোধ। এ প্রকৃতি মানুষের মৌলিক প্রাণ থেকে প্রেরণা পায় এবং সে প্রাণ থেকে তার মৌলিক প্রাণকে অহরহ প্রেরণা জোগায়। মৌলিক প্রাণের প্রেরণা গ্রহণই ফেরেশতা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য এবং তার ওপরেই সে প্রেরণা প্রাধান্য বিস্তার করে।
দুই. পশু প্রকৃতি তথা প্রবৃত্তি। অন্য সব পশুর ভেতর যে জৈব প্রবৃত্তি আছে, সেটাই মানুষের পশুপ্রকৃতির ভিত্তি ও উৎস। যে চার উপাদানে মানুষের যৌগিক প্রাণের সৃষ্টি, এ প্রকৃতিতেও তা বর্তমান। পশু প্রকৃতি সম্পূর্ণ স্বাধীন। মৌলিক প্রাণও তার নির্দেশ মেনে নেয়।
এই দুই শক্তির ভেতর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চলে। কখনো বিবেক প্রবৃত্তিকে ওপরে ওঠাতে চায়, কখনো প্রবৃত্তি বিবেককে নিচে নামাতে চায়। বিবেক পরাজিত হলে প্রবৃত্তির প্রভাব প্রকাশ পায় এবং প্রবৃত্তি পরাজিত হলে বিবেকের প্রভাব প্রকাশ পায়। আল্লাহ দুটোই প্রকাশের সুযোগ দেন। উপার্জনকারী যেটা উপার্জন করতে চান, তিনি সাধারণত সেটাই দেন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকি হলে এবং যা উত্তম তা সত্য বলে গ্রহণ করলে, আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। কেউ কার্পণ্য করলে ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে আর যা উত্তম তা অস্বীকার করলে তার জন্য আমি সুগম করে দেব কঠোর পথ।’ (সুরা : লাইল, আয়াত : ৫-১০)
মানবজাতিকে আল্লাহ প্রদত্ত ভালো ও মন্দ কাজের যোগ্যতা ও দায়িত্বের কারণেই মানুষকে পরকালে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। কেননা তার যোগ্যতার দাবি সে পুণ্যের কাজ করবে এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকবে। এটা তার দায়িত্ব।