ভালোবাসা একটি সুন্নাত আমল। তবে এটি বর্তমান সময়ের প্রচলিত ভালোবাসা দিবসের ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা কেমন হবে? কাকে ভালোবাসতে হবে? কি জন্য ভালোবাসতে হবে? ভালোবাসার মানদণ্ড কেমন হবে? এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। এই ভালোবাসার মানদণ্ড কী?
কাউকে ভালোবাসা এবং কারও সাথে শত্রুতা রাখার মানদণ্ড হলো একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। যে ভালোবাসায় আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই; সে ভালোবাসা ইসলাম অনুমোদন দেয় না। ব্যক্তি, পরিবার, আপনজন ও আত্মীয়স্বজন; সমাজ, দেশ, ধর্ম-বর্ণ সব ভালোবাসার দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। আর এর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মহান আল্লাহর ভালোবাসা। তিনিই এসবের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করেন।
তাই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসতে হবে এবং শত্রুতাও যদি কারও সঙ্গে করার প্রয়োজন হয়; তা-ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কারও সাথে শত্রুতাও করা যাবে না। এটাই ইসলামের শ্রেষ্ঠতম কর্মপন্থা। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালোবাসার সুন্নাত আমলটি সম্পর্কে এভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন-
إِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ الْحُبُّ فِي اللَّهِ وَالْبُغْضُ فِي اللَّهِ নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কারও সঙ্গে শত্রুতা রাখা। (মুসনাদে আহমাদ)
কোনো ব্যক্তি ঈমানের পরিচয় দিতে গেলেও কাউকে ভালোবাসবার আগে আল্লাহর জন্য হৃদয়ের গভীরে সুদৃঢ় ভালোবাসা রাখতে হবে। যদিও কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম করে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمِنْ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালোবাসার মত তাদেরকে ভালোবাসে কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা সুদৃঢ়। (সুরা বাকারাহ : আয়াত ১৬৫)
আল্লাহকে ভালোবাসা ছাড়া কোনো ব্যক্তি ঈমানের স্বাদও পাবে না। তাই ভালোবাসতে হবে আল্লাহকে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেন-
ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে; সে ঈমানের স্বাদ পায়। তাহলো-
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অন্য সব কিছু থেকে সবচেয়ে প্রিয় হওয়া। ২. শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসা।
৩. কুফুরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দ করা। (বুখারি)
ভালোবাসার ফজিলত
১. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যারা পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে, কেয়ামতের দিন তাদেরকে তিনি তাঁর রহমতের ছায়ায় জায়গা দেবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلَالِي الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّي
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আহ্বান করবেন, আমার মহত্ত্বের নিমিত্তে পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় স্থান দান করবো। আজ এমন দিন, যে দিন আমার (আরশের) ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া নেই। (মুসলিম)
২. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন- إِنَّ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ لَأُنَاسًا مَا هُمْ بِأَنْبِيَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ يَغْبِطُهُمُ الْأَنْبِيَاءُ وَالشُّهَدَاءُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِمَكَانِهِمْ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ تُخْبِرُنَا مَنْ هُمْ قَالَ هُمْ قَوْمٌ تَحَابُّوا بِرُوحِ اللَّهِ عَلَى غَيْرِ أَرْحَامٍ بَيْنَهُمْ وَلَا أَمْوَالٍ يَتَعَاطَوْنَهَا فَوَ اللَّهِ إِنَّ وُجُوهَهُمْ لَنُورٌ وَإِنَّهُمْ عَلَى نُورٍ لَا يَخَافُونَ إِذَا خَافَ النَّاسُ وَلَا يَحْزَنُونَ إِذَا حَزِنَ النَّاسُ <নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যারা নবিও নয় এবং শহীদও নয় কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি সম্মানজনক অবস্থান দেখে (অন্য) নবি এবং শহিদগণও ঈর্ষান্বিত হবে।
সাহাবাগণ জানতে চেয়ে বললেন- হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বলুন; তারা কারা?
তিনি বলেন তারা ওইসব লোক যারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালোবাসেছে। অথচ তাদের মধ্যে কোনো রক্ত সম্পর্ক নেই এবং কোনো অর্থনৈতিক লেন-দেনও নেই।
আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই তাঁদের চেহারা হবে নূরানি এবং তারা নূরের মধ্যে থাকবে। যে দিন মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে, সে দিন তাঁদের কোনো ভয় থাকবে না। এবং যে দিন মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকবে, সে দিন তাঁদের কোনো চিন্তাও থাকবে না। (আবু দাউদ)
পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধির উপায়
পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি তৈরি না হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ারও সুযোগ নেই। শান্তি ও নিরাপত্তা পাওয়ারও কোনো উপায় নই; এমনকি জান্নাতেও যাওয়া যাবে না বলেছেন বিশ্বনবি। সে কারণেই নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিনদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বাড়াতে একটি চমৎকার উপায় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন-
لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার না হবে তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য স্থাপন করবে। আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ের কথা বলবো না যা করলে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হবে সাহাবাগণ বললেন নিশ্চয়ই হে আল্লাহর রাসুল! (এরপর তিনি বললেন) তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সালামের প্রচলন করো।(মুসলিম)
এ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর পরস্পরের ভালোবাসার মানদণ্ড। যেখানে নেই কোনো অশ্লীলতা। নেই পাপাচারের কোনো সুযোগ। আছে দুনিয়ার সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতির দিকনির্দেশনা এবং পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তার ঘোষণা।
সুতরাং মুমিন মুসলমানসহ বিশ্বব্যাপী মানুষের উচিত, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে মুক্ত থেকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করা। কোরআন-সুন্নাহ ঘোষিত ভালোবাসার মানদণ্ড অনুসরণ ও অনুকরণ করা। আর এতেই আসবে শান্তি ও কল্যাণ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামের মানদণ্ড বজায় রেখে পরস্পরকে ভালোবাসার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর সন্তুষ্টিই হোক ভালোবাসার চূড়ান্ত মানদণ্ড। আমিন।