নিয়ত তথা সঙ্কল্প বা ইচ্ছা, অভিপ্রায় ইবাদতের মূল। নিয়ত শব্দটি ইখলাসের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। নিয়ত ইবাদতের প্রাণ। কুরআনুল কারিমে হুবহু নিয়ত শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কুরআনুল কারিমে ইখলাস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, একান্ত নিষ্ঠাবান (মুখলিস) হয়ে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো। জেনে রেখো, একনিষ্ঠ (ইখলাসযুক্ত) ইবাদত আল্লাহ তায়ালার জন্যই। (সূরা জুমার) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, এদের এ ছাড়া আর কোনো কিছুরই আদেশ দেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহ তায়ালার জন্য নিজেদের দ্বীন ও ইবাদত নিবেদিত (খালেস) করে নেবে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। (সূরা বাইয়িনাহ)
হাদিসে নিয়ত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইমাম বুখারি রাহ. বুখারি শরিফের প্রথমে ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে নিয়ত সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, সব কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল লাভ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই গণ্য হবে। অন্য দিকে, যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার মানসে হিজরত করে তার হিজরত সে উদ্দেশেই গণ্য হবে যে জন্য সে হিজরত করেছে।
নিয়তের জন্য ইখলাস প্রয়োজন আবার ইখলাসের জন্য সহিহ নিয়ত প্রয়োজন। ইসলামে প্রত্যেকটি কাজই ইবাদত। হোক সেটা ফরজ, হোক ওয়াজিব, হোক সুন্নাত, চাই নফল হোক, চাই মুস্তাহাব হোক। কাজটি করার আগে নিয়ত করা জরুরি। কোনো কাজ করার আগে সরবে হোক কিংবা নীরবে হোক কাজটি করার সঙ্কল্প বা অভিপ্রায় ব্যক্ত করার নামই নিয়ত। নিয়তের স্থান হলো অন্তর। নিয়ত নিজেও একটি ইবাদত। নামাজের আগে পবিত্রতা অর্জন, অজু যেমন স্বতন্ত্র ইবাদত তেমনি ইবাদতের আগে নিয়তও একটি ইবাদত। ইবাদতের সৌন্দর্য অনেকাংশে নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। যার নিয়ত যত বিশুদ্ধ তার ইবাদত তত সুন্দর।
বিশুদ্ধ নিয়তের জন্য চারটি গুণ থাকা প্রয়োজন-
১. নিয়তকারীকে মুসলিম হতে হবে; ২. নিয়তকারীকে সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে; ৩. যে কাজ বা ইবাদতের জন্য নিয়ত করছে সেই কাজ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা চাই; ৪. যে কাজ বা ইবাদত করতে চায় তা করার সুন্নাত নিয়ম এবং উদ্দেশ্য জানা থাকা চাই।
বিশুদ্ধ নিয়তের জন্য মানুষ সওয়াবের ভাগিদার হয়ে যায়। শরিয়াহসম্মত কোনো কারণে কাজটি করতে না পারলেও সে নিয়তের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয় না। কাজটি করতে পারলে কাজের সওয়াব পায়।আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের বলেন, আমার বান্দা কোনো গুনাহের কাজ করার নিয়ত করলে তা না করা পর্যন্ত তার জন্য কোনো গুনাহ লিপিবদ্ধ করো না। তবে সে যদি গুনাহের কাজটি করে ফেলে, তাহলে কাজটির অনুপাতে তার গুনাহ লিখো। আর যদি আমার কারণে তা পরিত্যাগ করে তাহলে তার জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ করো। সে যদি কোনো নেকির কাজ করার জন্য ইচ্ছা বা নিয়ত করে কিন্তু এখনো তা করেনি তাহলে তার জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ করো। আর যদি কাজটি সে করে তাহলে তার জন্য ১০ গুণ থেকে (আন্তরিকতা অনুপাতে) ৭০০ গুণ পর্যন্ত নেকি লিপিবদ্ধ করো। (সহিহ বুখারি)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, বলুন প্রত্যেকেই আপন স্বভাব অনুসারে কর্ম সম্পাদন করে থাকে। (সূরা বনি ইসরাইল-৮৪) এখানে আপন স্বভাব অর্থ নিয়ত অনুযায়ী। মানুষ তার পরিবারের জন্য সওয়াব লাভের নিয়তে যা খরচ করে, তা সাদাকাহ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, এখন মক্কা থেকে হিজরত নেই; কিন্তু জিহাদ ও নিয়ত অবশিষ্ট রয়েছে। আবু মাসউদ রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, মানুষ তার পরিবারের জন্য সওয়াবের নিয়তে যখন খরচ করে তখন তা হয় তার সদকা স্বরূপ।; (বুখারি)
সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা:-কে বলেন, তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা-ই খরচ করোনা করো না কেন, তোমাকে তার সওয়াব অবশ্যই দেয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তারও। (বুখারি)
কোনো শাইখ বলেন, আমার মন চায়, কিছু ফকিহ তাদের অন্যান্য ব্যস্ততা ছেড়ে দিয়ে মানুষদের শুধু তাদের আমলের মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যসমূহ শিক্ষা দেয়ার কাজ করুক এবং লোকদেরকে তাদের আমলের নিয়তের বিশুদ্ধতা শিক্ষা দেয়ার কাজে বসে যাক। কারণ অন্তরের আমলের প্রতি অজ্ঞতার কারণে, অন্তরের আমলের হালাত না জানার কারণে অনেক মানুষই ইবাদত করেও ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে যায়। এমনকি দ্বীনী ইলমের ধারক বাহকরা ইলম অর্জন ও বিতরণের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত না করে তবে তার জন্যও কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি রয়েছে। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, যে ইলম দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। এমন ইলম কেউ যদি শুধু দুনিয়ার স্বার্থে হাসিলের জন্য শিক্ষা করে, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। (আবু দাউদ)
নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে ইবাদতে রিয়া বা লোক দেখানো ভাব স্থান করে নেয়, মন বিক্ষিপ্ত থাকে, ইবাদতে মন বসে না। ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা অনেকাংশ নিয়তের ওপর নির্ভর করে। নিয়ত নিয়ে আয়েম্মায়ে কেরাম অনেক আলোচনা করেছেন, আমরা মহানদের কিছু উক্তি জানব-
ইয়াহইয়া ইবনে কাছির রাহ. বলেন, তোমরা নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে শিখো। কেননা, এর প্রভাব আমলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারাক রাহ. বলেন, অনেক ছোট আমল নিয়তের কারণে মহান কাজে পরিণত হয়। মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ রাহ. বলেন, অন্তর পরিশুদ্ধ হয় সঠিক আমলের মাধ্যমে। আর আমল পরিশুদ্ধ হয় বিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে।
সুফইয়ান সাওরি রাহ. বলেন, আমাকে নিয়তের চেয়ে কঠিন কোনো কাজে অনুশীলন করতে হয়নি। কারণ আমার নিয়ত বারবার বিগড়ে যায়।ইমাম ইবনুল কাইয়ুম রাহ. বলেন, অন্তরের আমলই মূল। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল অন্তরের অনুগামী শাখা-প্রশাখা ও পূর্ণাঙ্গ রূপ। নিয়ত হলো রূহের মতো। আর আমল হলো দেহের মতো। রূহ ছাড়া দেহ মৃত। তাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের আহকামের চেয়ে অন্তরের আমলের আহকাম সম্পর্কে জানা বেশি জরুরি।আমরা নিয়ত নিয়ে কথা বলি, আলোচনা করি। কিন্তু নিয়ত বিশুদ্ধ আর খাঁটি করার জন্য আমাদের কোনো মেহনত নেই। নিয়ত বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি, পন্থা জানার আমাদের কোনো চেষ্টা নেই। অথচ প্রতিদিন নামাজে নিয়ত করছি, অজুুতে নিয়ত করছি, অন্যান্য ইবাদতে নিয়ত করছি। সেই নিয়তকে কতটুকু মানে নিতে পারছি, তা নিয়ে সামান্য ভেবে দেখারও সময় নেই। আসুন ইবাদতের পেছনে যেভাবে মেহনত করছি, সময় দিচ্ছি, ইবাদতের নিয়ত, ইখলাস, বিশুদ্ধতার চিন্তায় সময় দেই। নিজেকে পরিশুদ্ধ করি। পরকালীন মুক্তির পথ তালাশ করি।