
১২ ই রবিউল আওয়াল রহমাতুল্লিল আলামিন, ইমামুল আম্বিয়া,সাইয়িদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন, তাজেদারে মদিনা মুহাম্মদ (সা.) এর শুভ আগমনের মাস। রবিউল আওয়াল মাস নবী প্রেমিক ও আশেকে রাসূলের জন্য একটি গুরত্বপূর্ণ মাস। রবিউল আউয়াল মাস আসলে মুসলমানদের মনে এক আনন্দ বিরাজ করে। রাসূল পাক (সা.) এর শুভ আগমন পৃথিবী বাসীর জন্য বড় নেয়ামত। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরন করেছি। (সূরা আম্বিয়া--১০৭)। নবী মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবী হিসেবে আইয়ামে জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোকিত করতে পৃথিবীতে আগমন করেন। মহানবী (সা.) আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ঘনীভুত অন্ধকার চিরে আলোকিত হল পৃথিবী। উনার স্বর্গীয় বার্তার সামনে জালেমের কন্ঠস্বর নিস্তব্ধ হলো, সখল নির্যাতন দূর হলো।
রহমতের নবী নিয়ে এলেন শান্তির অমীয় বানী। মহানবী (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম, মানবতা ও শান্তির বানী ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষ কোন জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি, তিনি কোন বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের জন্য ও প্রেরিত হননি। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য। রাব্বুল আলামিন বলেন, আর আমি আপনাকে পাটিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। (সূরা আস সাবা--২৮)। মানমবতার মহান দূত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় আগমন করেই মানুষ ও সকল প্রানীর জন্য মানবতা এবং শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দেন। তিনি কেবল মানুষের অধিকারের কথা বলেননি। তিনি সকল পশু পাখি,জীব জন্তু, কীট পতঙ্গের জন্য মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ৬৩ বছর জীবন ব্যয় করেন। এজন্য মহানবী (সা.) মানুষ ও সখল প্রানীর জন্য রহমত স্বরুপ।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন শান্তির মূর্ত প্রতীক। যুদ্ধ পরিহার করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিভিন্ন শান্তিচুক্তি স্থাপন করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি ও মদিনা সনদ হচ্ছে শান্তি স্থাপনের জন্য বড় উদাহারন। তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে হিংসা বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। তিনি দল-মত-গোত্র নির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকলের মাঝে শান্তচুক্তি এবং সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তৎকালীন আরবের বর্বর লোকেরা নারীজাতিকে ভোগ বিলাসের বস্তু ছাড়া কিছুই মনে করতেন না। মনুষত্বহীন পিতারা নিজ কন্যা সন্তানকে মাটিতে জীবন্ত পুঁতে ফেলতে দ্বিধাবোধ করত না। মহানবী এসে অধিকার বঞ্চিত সব নারী জাতির অধিকার ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। জুলুম নিপিড়ন থেকে মুক্তি দান করেন। তিনি স্পষ্ট ও নির্ভীক কন্ঠে ঘোষনা করেন ‘নারী কেনাবেচার বস্তু ও ভোগ্যসামগ্রীর বস্ত নয়’। তিনি আরো ঘোষনা দিলেন ‘শিশু কন্যা হত্যা করো না। ইসলামে এটি জঘন্য অন্যায়। এতিম-অনাথদের স্বার্থ রক্ষা কর। তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন করো না।’ তিনি নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও অধিকারের স্বীকৃতি দিলেন।
সামাজিক শান্তির জন্য ব্যাভিচার নিষিদ্ধ করলেন। নারী পুরুষের সমতা ঘোষনা করে প্রতিষ্ঠা করলেন তাদের উত্তরাধিকার। কন্যা সন্তানকে একসাথে স্বামী ও বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার বানালেন। পিতার উপর কন্যার লালন পালন এবং স্বামীর উপর স্ত্রীর ভরনপোষণকে বাধ্যতামূলক করলেন। রাসূল পাক (সা.) বিয়ের আগে স্বামীর উপর মহরানা ধ্যার্য করলেন। তালকপ্রাপ্ত ও বিধবা নারীকে দিলেন ন্যায্য অধিকার। পুরুষের সঙ্গে নারীকে দিলেন সামাজিক মর্যাদা, ধর্মীয়,অর্থনৈতিক, আইনগত অধিকার। নারীজাতি মায়ের পায়ের তলে সন্তানের জন্য জান্নাতের ঘোষনা দিয়োছেন। ফলে নারী জাতি পেয়েছে তাদের ন্যায্য অধিকার এবং অবমাননা ও লাঞ্চনার গ্লানি থেকে ইজ্জত-আব্রু রক্ষা পেয়েছে। জাহেলিয়তের যুগে গোটা মানবজাতি ছিল কূফর ও শিরকে নিমজ্জিত। সে সমাজে ফেতনা-ফাসাদ, অন্যায়-অভিচার,পাপাচার-অশ্লীলতা চরম আকার ধারন করেছিল।
জাতির এমন চরম দুর্দিনে মানবতার মুক্তির দূত প্রিয় নবীজি (সা.) এর আদর্শের প্রভাবে অল্প কয়েকদিনে জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায়। রাসূল (সা.)পৃথিবীতে এসে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে মানবাধিকারের ভিত্তিতে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষনে ঘোষনা করেন, শোনো আরবের উপর অনারবের, অনারবের উপর আরবের, শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের এবং কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্য ও মর্যাদা নেই। তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে হিংসা বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। মহানবী (সা.) সেগুলোর অবসান ঘটিয়ে তাদের মধ্য ভ্রাতৃত্বের বীজ বপন করেন। রাসূল (সা.) দুনিয়ায় আগমন করে মানবাধিকার তথা প্রতিটি মানুষের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বংশ মর্যাদা, শ্রেনীবিভেদ, জাতি গত বিভেদ ও বর্ণ বিভেদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। দাস-দাসী ও অধিন্যস্তদের প্রতি সুন্দর ও ন্যায়ানুগ ব্যবহার করতে নির্দেষ দেন।
তিনি সমাজব্যবস্থায় উঁচ-নিচু,ধনী গরীব, কালো- সাদার বৈষম্য দূর করেন। শধুমাত্র মুসলিম নয় অমুসলিম জনগনের জান ও মালের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল সে জান্নাতের সুগন্ধ পাবে না। (বুখারী-২৯৯৫)। পৃথিবীতে নবী ও রাসূলগণের প্রধান কাজ ছিল আল্লাহর বিধানের আলোকে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক একটি শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নবী মুহাম্মদ (সা.) পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, ক্ষমা ও ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অত্যাচার, অবিচার, বৈষম্য, সহিংসতা ও হানাহানি পরিহার করে শান্তি ও সম্প্রীতির পথ অবলম্বনের নির্দেশ দেন। সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ইসলামি সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। মুহাম্মদ (সা.) ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টন, জীবন, সম্পদ ও জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জুলুম-অবিচার -কূসংস্কার বন্ধ, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সমাজের সকলের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কার্যাবলির মাধ্যমে তিনি এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।