অত্যাচার ব্যক্তির ঘৃণিত স্বভাব। গুরুতর অপরাধ। মহাপাপ, যা ব্যক্তির দ্বীনকে বিনষ্ট করে। নেক কর্মগুলোকে ধূলিসাৎ করে। পরস্পরে শত্রুতা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। জীবনকে দুর্বিষহ করে। ব্যক্তিকে আল্লাহবিমুখ করার মাধ্যমে জাহান্নামের উপযুক্ত করে। মানুষের যেসব গুণ ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য তার অন্যতম অত্যাচার। নবীজী উম্মতকে চরিত্র কলুষিতকারী সব প্রকারের কুস্বভাব আত্তীকরণ থেকে মানা করেছেন। মানুষের উচিত অত্যাচারের পরিণতি স¤পর্কে চিন্তা করে তা থেকে বিরত থাকা।
অত্যাচার কী : শাব্দিকভাবে সীমালঙ্ঘন ও অপাত্রে স্থাপন করাকে অত্যাচার বলে। পরিভাষায় সত্যবিচ্যুত হয়ে মিথ্যার পক্ষাবলম্বন করাই অত্যাচার। অন্যভাবে বললে, প্রত্যেক কষ্টদায়ক বস্তু যার দ্বারা অন্যকে আঘাত পৌঁছানো হয়, তাই অত্যাচার। (আল-ফকিহ ওয়াল-মুতাফাক্কিহ-৩৯৪) মুসলমানদের উচিত অত্যাচারকে ভয় করা। তা থেেেক বিরত এবং দূরে থাকা। অত্যাচারের মতো আখেরবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়া।
যে অত্যাচার আল্লাহ ক্ষমা করবেন না : আনাস ইবনে মালেক রা: নবীজী থেকে বর্ণনা করেছেন- জুলুম তিন প্রকার : প্রথমত এমন জুলুম যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। দ্বিতীয়ত, এমন জুলুম যা তিনি ক্ষমা করবেন। তৃতীয়ত, এমন জুলুম যা আল্লাহ ছেড়ে দেবেন না। আল্লাহ শিরকের (আল্লাহর অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত করা ) জুলুম ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ তাঁর সাথে শিরককারীকে ক্ষমা করবেন না।’ (সূরা নিসা-৪৮) আল্লাহ এবং বান্দার অভ্যন্তরীণ জুলুমকে তিনি ক্ষমা করবেন। তবে ব্যক্তি কর্তৃক ব্যক্তির প্রতি জুলুমকে আল্লাহ ছেড়ে দেবেন না। যতক্ষণ মাজলুম ব্যক্তি ক্ষমা করবেন না, ততক্ষণ জালেমকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। (মাজমাউজ-জাওয়ায়েদ ১০ : ৩৫১) আমাদের আজকের মূল প্রতিপাদ্য এই তিন নম্বর জুলুম। বিষয়টি কতটা কঠিন, তা পাঠক মাত্রই বুঝতে সক্ষম।
রাজনৈতিক অত্যাচার : রাজনৈতিক নিপীড়ন, যে নিপীড়নে জর্জরিত গোটা পৃথিবী। রাজনৈতিক জুলুমে দেশে দেশে যত মানুষের হত্যা হয়েছে, অন্য কোনো জুলুমে এমনটি হয়নি। স্বৈরাশাসকরা রাজনৈতিক অত্যাচারের মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করে। সিংহাসনকে মজবুত ও দীর্ঘমেয়াদি করার প্রয়াস পায়। তারা বুঝতে চায় না যে, ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা যে রাজত্ব কায়েম করা যায়, জুলুমের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। অত্যাচার দুষ্ট লোকদের একমাত্র হাতিয়ার। মনে রাখা দরকার, জুলুম (জুলুমকারী) কিয়ামতে অন্ধকারে থাকবে। (মুসলিম-২৫৭৮) জুলুমের মাধ্যমে নির্দোষকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখলে, প্রতিদানে আপনাকেও জাহান্নামের প্রকোষ্ঠে জ্বলতে হবে। দুনিয়াতে তারা হয়তো, হাওয়া-বাতাস আর ঠাণ্ডা পানি পাচ্ছে। অত্যাচারীর জন্য জাহান্নামে কিন্তু হাওয়া-বাতাস আর ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা থাকবে না।
অত্যাচারী নেতা থেকে নবীজীর আশ্রয় : আমরা অনেকেই অত্যাচারী ব্যক্তিকে নেতা ও অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসেবে মান্য করি। জালেমরা এদের মাধ্যমে অন্যের ওপর নিগ্রহের স্টিমরোলার চালায়। নেতাদের অত্যাচারের সহযোগী এই চ্যালা-চামুণ্ডারা। এরা বোঝে না পাপিষ্ঠ নেতা তাদের কতটা ক্ষতি করছে। অজান্তেই তারা নিজেদের আখিরাত ধ্বংস করছে। নবীজী এমন নেতা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, যারা তাদের অনুসারীদের দ্বারা অত্যাচার চালায়।
উমর ইবনে খাত্তাব রা: বলেন, নবীজী বলেছেন, ‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি অনিষ্টকারী পাপিষ্ঠ নেতা থেকে, যারা আমার উম্মতকে জুলুমের অনিষ্টের দিকে নিয়ে যায়।’ (মুজামুল আওসাত ৫ : ৯৬)
অত্যাচারে জালেম নিজেরই ক্ষতি করে : অন্যের প্রতি অত্যাচারের মাধ্যমে জালেম নিজেরই ক্ষতি করে। কিন্তু অহমিকার কারণে সে তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। আবু হোরায়রা রা: এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, অত্যাচারী স্বীয় অত্যাচারের কারণে নিজেরই ক্ষতি করেন। তখন তিনি বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহর শপথ! জুলুমের কারণে পাপিষ্ঠরা স্বীয় আসনে লাঞ্ছনাকর মৃত্যুমুখে পতিত হয়। (হেদায়াতুর রুয়াত-৫০৬৪) সাখাবি রহ: থেকে বর্ণিত- অত্যাচারীর ঘর নষ্ট হবেই যদিও সেটি কয়েক যুগ পরেও হয়। (আল মাকাসেদুল হাসানা-২৫১) জালেম স্বীয় ধ্বংস ও বিনাস কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারবেন না। পৃথিবীর ইতিহাস এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
আল্লাহ অত্যাচারীর রশি ঢিল দেন : জুলুম-অত্যাচারে নির্ভীক ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ চূড়ান্ত সুযোগ দেন, যার কারণে তারা নির্যাতন আর নিপীড়নে মত্ত হয়। তাওবাহ করার তাওফিক পায় না। একপর্যায়ে অত্যাচারের পাল্লা এতটা ভারী হয় যে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। তখন কোনো কিছুই তাদেরকে আজাব থেকে রক্ষা করতে পারে না। আবু মূসা আশয়ারি রা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেমের জুলুম দীর্ঘায়িত করে উপভোগ্য করেন। এমনকি যখন তাকে ধরেন তখন সে পলায়ন করতে পারে না।’ (বুখারি-৪৬৮৬) সূরা হুদে এসেছে- ‘আর তোমার রব যখন পাপপূর্ণ কোনো জনপদকে ধরেন, তখন এমনিভাবেই ধরে থাকেন। নিশ্চয়ই তার পাকড়াও মারাত্মক, বড়ই কঠোর। (১০২)
সর্বসম্মুখে অত্যাচারীর বিচারকাজ সম্পাদন: কিয়ামতে মু’মিনদের বিচারকাজ পর্দার আড়ালে করা হবে। কিন্তু জালেমের বিচারকাজ সর্বসম্মুখে ঘোষণার মাধ্যমে শুরু করা হবে। যার কারণে তাদের মুক্তি পাওয়ার কোনো অবকাশ থাকবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, আমি নবীজীকে বলতে শুনেছি, ‘কিয়ামতে মু’মিন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিকটবর্তী করা হলে আল্লাহ তাকে স্বীয় কুদরতে ঢেকে নেবেন। সেখানে তার গুনাহের স্বীকারোক্তি নেবেন। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি এই গুনাহ করেছ? মু’মিন ব্যক্তি বলবেন হ্যাঁ। সে আবার বলবে হে রব, আমি এই ুনাহ দু’বার করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন, দুনিয়াতে এই গুনাহ গোপন রেখেছিলাম। আজকেও গোপন রেখে তোমাকে মাফ করলাম। অতঃপর কাফের এবং অন্য জালেমদের বিচারের জন্য সব সাক্ষীর সামনে চিৎকার করে বিচারকাজ শুরু করা হবে।’ (বুখারি-৪৬৮৫) ‘সাক্ষীরা বলবে, এরাই ওই সব লোক যারা তাদের পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। শুনে রাখো, জালেমদের ওপর আল্লাহর অভিস¤পাত রয়েছে।’ (সূরা হুদ-১৮)
আল্লাহ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলেন: জালেম নিজের কুৎসিত কর্মকাণ্ডে আপন ধ্বংস আহ্বান করেন। অত্যাচারমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্য জালেম সৃষ্টিতে সাহায্য করেন। তার পাশেই তার শত্রু বেড়ে ওঠে। অনেকটা দুধ দিয়ে কালসাপ পোষার মতো। যে তার ধ্বংসের কারণ হয়। আল্লাহ জালেম দিয়ে জালেম মারেন। আফসোস! এই ঐতিহাসিক সত্য থেকে জালেমরা শিক্ষা নেয় না। মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল-গুজ্জা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম দ্বারাই জালেমের প্রতিশোধ নেন। অতঃপর সবাইকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন। (ইতকান ১ : ৩৪৪) ইমাম জারকাশি বলেন, পৃথিবীতে জালেম আল্লাহর শত্রু। তার দ্বারা শাস্তি দেন। অতঃপর তার থেকে প্রতিশোধ নেন। (আল-লাআলিল মানসুরা-১৭৪)
অত্যাচারীর উপাকারার্থে বাধা দেয়া : আনাস ইবনে মালেক রা: বলেন, নবীজী সা: বলেছেন, ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো। সে জালেম হোক বা মাজলুম।’ সাহাবিরা বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মাজলুমকে সাহায্য করার বিষয় তো বুঝলাম কিন্তু জালেমকে কিভাবে সাহায্য করব? উত্তরে নবীজী বললেন, ‘তাকে জুলুম করা থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে।’ (ইবনে হিব্বান-৫১৬৭) জুলুমের অবধারিত গন্তব্য জাহান্নাম। যদি কোনো মুসলিম জুলুম করে, তাহলে তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখাও অন্যান্যদের দায়িত্ব, যাতে সে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পেতে পারে। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাকে বিরত রাখা সামর্থ্যবানদের দায়িত্ব। এর মাধ্যমে মাজলুম দুনিয়ায় তার জুলুম থেকে রেহাই পাবে। আর জালেম আখিরাতে শাস্তি থেকে নাজাত পাবে।
আল্লাহ নিজের প্রতি জুলুমকে হারাম করেছেন : মহান আল্লাহ যিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক। অহঙ্কার, বড়ত্বের একমাত্র যোগ্য যিনি। যিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তাকে বাধা দেয়ার কিংবা প্রশ্ন করার কেউ নেই। তিনি নিজে কখনো কারো প্রতি অত্যাচার করেন না। অন্যের প্রতি অত্যাচারকে সহ্যও করেন না। নবীজী আল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ‘হে আমার বান্দারা নিশ্চয়ই আমি নিজের ওপর জুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের মাঝেও জুলুমকে হারাম করেছি। অতএব, তোমরা পরস্পরের প্রতি জুলুম করো না।’ (মুসলিম-২৫৭৭)
নবীজীর উদাত্ত আহ্বান : নবীজী আমাদেরকে অত্যাচার থেকে বিরত হতে উদাত্ত আহ্বান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে মানুষ! তোমরা অত্যাচার থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, জুলুম (অত্যাচারী) কিয়ামতে অন্ধকারে থাকবে।’ (মুসলিম-২৫৭৮) মানুষ বা প্রাণিকুল যে কারো প্রতি অত্যাচার, অনাচার, নিপীড়ন ও উপদ্রব করা হারাম। নবীজী উম্মতকে জুলুম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, কারণ জুলুমে পরকাল নষ্ট হবে। শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামতে যার আলো থাকবে না, সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।