ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহ তথা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিহাদ ইত্যাদি মহানবী সা:-এর মাদানি জীবনে ফরজ হয়। নামাজ হিজরতের ১১ মাস আগে রজবের ২৭ তারিখে মেরাজের রাতে ফরজ হয়, তবে পড়ার নির্দেশ হয় প্রথম হিজরিতে। জিহাদ ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে, রোজা ও জাকাত ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরিতে, হজ ফরজ হয় অষ্টম, মতান্তরে নবম হিজরিতে। এসব বিধান মদিনায় ফরজ হওয়ার রহস্য হলো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া ছাড়া মানুষ তা পালন করবে না। ইসলামী সরকার মুসলিম প্রজাদেরকে এসব বিধান পালন করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাবে।
আল্লাহ তায়ালা রোজার বিধান ফরজ করার ক্ষেত্রে প্রথমত সান্ত্বনামূলক বাণী পেশ করছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে (রোজা) তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল (সূরা আল বাকারা-১৮৩)। রোজা ফরজ করার সাথে এ সান্ত্বনাও দেয়া হয়েছে যে রোজা একটু কষ্টকর হলেও এ বিধান নতুন নয় বরং আগেও সব উম্মতের ওপর তা ফরজ ছিল। তারা যেহেতু রোজা পালন করতে পেরেছে, তোমরাও পারবে। রোজাকে ভয় করবে না, কষ্টকর মনে করবে না।
রোজার সূচনা : যারা নফসের গোলাম ও খেয়াল-খুশির পূজারি, তাদের জন্য রোজা অত্যন্ত কষ্টকর। তাই এ বিধানটি খুবই জোরালো শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত আদম আ: হতে অধ্যাবধি এ বিধান বরাবর চলে আসছে। হজরত আদম আ: জান্নাত থেকে বের হওয়ার পর তাঁর নূরানী চেহারা নষ্ট হয়ে যায়। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ তায়ালার কাছে তাঁর চেহারা সুন্দর করে দেয়ার জন্য আবেদন করেন। আল্লাহ তায়ালা তখন প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার নির্দেশ দেন এবং বলেন, এতে তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যাবে। পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর শরিয়তে চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজার বিধান ছিল। এ রোজা আইয়্যামে বীজের রোজা নামে পরিচিত। দাহহাক বর্ণনা করেছেন, হজরত নূহ আ: থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখার বিধান ছিল। এক মাস রোজার বিধান দেয়া হলে মাসিক তিন দিন রোজা রাখার বিধান রহিত হয়ে যায় (ইবন কাছির)। ইহুদিরা আশুরার রোজা রাখত। মহানবী সা: মদিনায় হিজরতের পর তা দেখে মুসলমাদেরকে আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দেন। তবে তাদের বিপরীত করার অর্থাৎ তারা রাখে একদিন, মুসলমানদের দুদিন বা তিন দিন রাখার আদেশ করেন। হজরত দাউদ আ: একদিন রোজা রাখতেন, একদিন ভঙ্গ করতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে শেষ নবীর উম্মতের ওপর আশুরা ও আইয়্যামে বীজের রোজার বিধান ছিল। পরে এর পরিবর্তে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়।
রোজার উদ্দেশ্য : রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন (সূরা বাকারা- ১৮৩)। তাকওয়া হলো এমন এক সদাসতর্ক মানসিক অবস্থা যা কাঁটাময় পথে পথিককে বাঁচাতে সাহায্য করে। তাকওয়া থাকলে মানুষ সব নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে এবং সব আদিষ্ট কাজ পালন করবে। রোজা বিভিন্নভাবে তাকওয়া সৃষ্টি করে। প্রথমত, রোজা হলো লৌকিকতামুক্ত ইবাদত। দ্বিতীয়ত, রোজা দ্বারা প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের প্রশিক্ষণ হয়। তৃতীয়ত, রমজান মাসের ২৪ ঘণ্টা চলে ইবাদতের অনুশীলন। চতুর্থত, রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা দুর্বল হয়। পঞ্চমত, রোজা একটি সংবেদনশীল সমাজ গঠনে সাহায্য করে; কারণ, সারা দিন উপবাস থেকে রোজাদার গরিব-দুঃখীর কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য ছয়টি। ১. সত্যের সন্ধান ২. সত্য গ্রহণ ৩. সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা ৪. আল্লাহভীতির মহানস্বভাব সৃষ্টি করা ৫. দায়িত্ব সচেতনতা ৬. আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় নিয়ে সব কাজ সম্পাদন করা।
মুসাফির ও রুগ্ন ব্যক্তির জন্য অবকাশ : আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের ওপর যা কিছু ফরজ করছেন, তাতে বান্দাদের দুর্বলতার প্রতিও তিনি লক্ষ রেখেছেন। ফলে মুসাফির ও রুগ্ন ব্যক্তিদের প্রতি এ অনুগ্রহ করেছেন যে, তারা সফর কিংবা অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রেখে অন্য সময় তথা সফর থেকে ফিরে এলে এবং অসুস্থতা কেটে গেলে রোজা রাখতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করতে হবে (সূরা বাকারা-১৮৪)। এতে সে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অনুকম্পাও ভোগ করল এবং আল্লাহর ফরজও পালন করল এবং রোজার মহামূল্যবান পুণ্য থেকেও বঞ্চিত হলো না।
তাফসিরে ইবনে কাছিরে রয়েছে রোজার অবস্থার পরিবর্তন হয় তিন বার। প্রথমত, রাসূল সা: মদিনায় এসে প্রতি মাসে তিনটি রোজা ও আশুরার রোজা রাখতেন। দ্বিতীয়ত, রোজা ফরজ করা হয়। তবে রোজা রাখা ও না রাখার এখতিয়ার দেয়া হয়। তৃতীয়ত, সুস্থ ব্যক্তিদের ওপর রোজা আবশ্যক করা হয়। কুরআন নাজিলের বার্ষিকী : রমজান হলো সেই মাস, যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে (বাকারা-১৮৫)। রমজান হলো কুরআন নাজিল হওয়ার বার্ষিকী। কুরআন নাজিল হওয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ মাসে ঘটেছে বলেই দীর্ঘ এক মাসব্যাপী এর বার্ষিকী পালন করা হয়। এ বার্ষিকী পালনের জন্য যেসব অনুষ্ঠানাদি রাখা হয়েছে, তার সামষ্টিক ফল হলো তাকওয়া। মুসনাদ আহমদ গ্রন্থে হজরত ওয়াসেলা ইবন আসকা থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী সা: বলেছেন, হজরত ইবরাহিম আ:-এর সহিফা পয়লা রমজান, তাওরাত ৬ রমজান, জবুর ১২ রমজান, ইঞ্জিল ১৩ মতান্তরে ১৮ রমজান এবং কুরআন মজিদ ২৪ রমজান নাজিল হয় (ইবন কাছির)।