পবিত্র মাহে রমজান আত্মশুদ্ধি, সাম্য, সহমর্মিতা ও মানবীয় গুণাবলী সৃষ্টির উদাত্ত আহ্বান নিয়ে এলো পবিত্র রমজান। মুসলিম জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজান অতি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রমজান মাস পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের মাস। মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়ার সমৃদ্ধি, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি, দৈহিক ও মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব আর গৌরব ও মর্যাদার অবিস্মরণীয় স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে মাহে রমজান। উন্নত চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায় পাশবিক বাসনার প্রাবল্যকে পরাভ’ত করত: পাশবিক শক্তিকে আয়ত্বাধীন করা হচ্ছে সিয়ামের তাৎপর্য। ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে সর্বত্র আল্লাহর দ্বীনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যাবতীয় প্রতিকূলতার মূখে টিকে থাকার জন্যে যে মনমানসিকতার প্রয়োজন সিয়াম সাধনার দ্বারাই তা অর্জিত হয়। মানবতার মহান নেতা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বিপ্লবী সাহাবারা এ মহান মাসে বদর যুদ্ধসহ লড়াই করেছিলেন বাতিলের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচার, জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে এবং মানুষের ওপর মানুষের প্রভ’ত্ব খতম করার লক্ষ্যে। তাই আজ শুধু রমজানের মাহাত্ম আউড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পাবার সুযোগ নেই। বরং মানবতা রক্ষার জন্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরাম আত্মত্যাগের যে নজির স্থাপন করে গেছেন, সেই ত্যাগের আদর্শ গ্রহণের মধ্যেই পবিত্র রমজানের চেতনা নিহিত। আজ প্রয়োজন রমজানের ত্যাগ-তিতিক্ষার সেই চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া। ইসলামের বিজয় পতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্যে পবিত্র রমজান মাসে সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস আমাদের কাছে এক শিক্ষার বাণী বহন করে ফেরে। রমজানে সংযম ও আত্মত্যাগের অনুশীলন এবং সেই সাথে ইসলাম ভিত্তিক ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ প্রয়োজন। এসব ত্যাগ-তিতিক্ষা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত, শাশ্বত ও জীবন্ত। তাই মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস রেখে অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুশীলন করার সুযোগ আসে রমজান মাসে। নৈতিকতা, শালীনতা ও ইফতার গ্রহণের মাধ্যমে সহমর্মিতার সদভ্যাস গড়ে তুলে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক কল্যাণ সাধনের পথ প্রশস্ত করার অনুশীলন করার মাস হচ্ছে রমজান। চিরায়ত ইসলামী মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ রক্ষায় ইসলামী নিয়ম-কানুন অনুশীলনের চেতনা জোরদার করতে হবে । তাছাড়া সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে মাফফিরাতের কামনা করতে হবে।
মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তাআলার এক বিশাল নেয়ামত হচ্ছে রমযান মাস। আমরা কি রমযানের হাকীকত এবং এর মর্তবা মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হওয়ার সামান্যতম কোনো গরযবোধ করছি? আমরা তো দিবানিশি দুনিয়ার ঝামেলার মধ্যে ডুবে রয়েছি। সকাল সন্ধ্যা নিজের ধান্ধা ফিকিরের চক্করেই সময় বিনষ্ট করছি। পার্থিব স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া আমাদের অস্থিমজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রমযান কি জিনিস তা নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় আমাদের কোথায়? রমযানের মাহাত্ম্য, এর গুরুত্ব, ফযীলত ও মর্তবা একমাত্র তাদের কাছেই রয়েছে, যারা এ মাসের বরকত সম্পর্কে অবগত। যারা জানে এ মাসটি খোদায়ী নূরে পরিপূর্ণ। এ মাসে আল্লাহর রহমতের প্লাবন বয়ে যায়, এ ধারণা যাদের আছে তারাই এ মাসের সম্মান করে থাকে। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেন, হে আল্লাহ! রজব এবং শাবান মাসে আমাদের উপর বরকত অবতীর্ণ কর। আর আমাদেরকে রমযানে পৌঁছিয়ে দাও। ( মাজমাউয যাওয়ায়িদ: খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৬৫)। এই হাদীসের মর্ম হল, আমাদের বয়স এতটুকু দীর্ঘ করে দাও, যেন রমযান মাসের সৌভাগ্য আমাদের অর্জিত হয়। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, দু’মাস পূর্ব থেকেই রমযানের জন্য অধীর অপেক্ষার পর্বটি শুরু হয়ে যায়। আর এই অপেক্ষার পর্বটি একমাত্র তাদের দ্বারাই হতে পারে, যারা এ মাসের মর্যাদা, এ মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত উপলব্ধি করতে সক্ষম।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা। তাই তিনি জ্ঞাত ছিলেন মানুষ দুনিয়ার ধান্ধায় জড়িয়ে তাঁকে ভুলে যাবে। দুনিয়ার কর্মকান্ডে সে যত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়বে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার একাগ্রতায় ততই দুর্বলতা আসবে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে একটি সূবর্ণ সুযোগ করে দিলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন: প্রতি বছর আমি তোমাদেরকে একটি মাস প্রদান করছি। এগার মাস দুনিয়াদারী এবং অর্থকড়ির ধান্ধার পেছনে ছুটাছুটি করার কারণে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। আন্তরিকতার সঙ্গে এই একটি মাস যদি তোমরা আমার কাছে প্রত্যাবর্তন কর, তাহলে এগার মাসে যে আধ্যাত্মিক ঘাটতি তোমাদের হয়েছে, আমার নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, এই মহান ও পবিত্র মাসে তোমরা তা পূরণ করে নাও। নিজের অন্তরের জং পাকসাফ করে পূত: পবিত্র হয়ে যাও। আমার সঙ্গে দূরত্ব হ্রাস করে নৈকট্য অর্জন করে নাও। অন্তরে আমার স্মরণ ও যিকির বাড়িয়ে দাও। মহান রাব্বুল আলামীন এই উদ্দেশ্যের নিরিখেই মুসলিম উম্মাহর জন্য রমযানের বরকতময় মাস দান করেছেন। এই উদ্দেশ্যাবলী অর্জনে,আল্লাহর নৈকট্য হাসিল ও সান্নিধ্য অর্জনে রোযার প্রথম ও প্রধান ভূমিকা রয়েছে। রোযা ছাড়া আর যেসব ইবাদত এই পবিত্র মাসে মুসলমানদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলোও আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হল, এই পুণ্যময় মাসের মাধ্যমে মানবজাতিকে নিজের কাছে টেনে নেয়া। শুধু উপবাস থাকাই রমজানের সাফল্যের শর্ত নয়, বরং উপবাসের সাথে যাবতীয় পাপ কাজ যেমন মিথ্যা কথা বলা, গীবত করা, চোগলখোরী, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার মতো ইসলাম বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর অনুশীলন না করলে রমজানের সুফল পাওয়া যাবেনা।