অজুর সময় কথা বলা কি নাজায়েজ?কোরআনের চর্চা অব্যাহত রাখা আবশ্যকশাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলতসৌদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতরবৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর
No icon

মুসলমানের অধঃপতনের কারণ ও উত্তরণের পথ

মানবতা যখন মরাণাপন্ন, গোটা পৃথিবী যখন জাহেলিয়াত ও বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, মারামারি-হানাহানি ও হত্যাযজ্ঞ যখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল ঠিক তখনই আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে ওহি ও রিসালাত দিয়ে প্রেরণ করেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তার আগমনে বিশ^বাসী মুক্তির পথ খুঁজে পেল। তিনি প্রদীপ্ত প্রদীপ হয়ে অন্ধাকারচ্ছন্ন এ জগতকে আলোকিত করলেন। দিশেহারা জাতিকে হেদায়েত ও মুক্তির পথ দেখালেন। মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলামীতে ন্যস্ত করলেন। জান্নাতের সুখ-শান্তি ও জাহান্নামের ভয়ভীতির বাণী শোনালেন। সৎ কাজের আদেশ ও উৎসাহ এবং অসৎ কাজে নিষেধ ও নিবৃত্তকরণের তালিম দিলেন। বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণ, ক্ষমাশীলতা ও আত্মসংযমের দীক্ষা দিলেন। আর এভাবেই অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত এক জাতি উত্তরণে আলোকিত পথের সন্ধান পায় এবং পরবর্তীদের জন্য অনুসরণীয় ও বরণীয় জাতিতে পরিণত হয়।

অধঃপতিত এ জাতিকে উন্নতির শিখরে নিতে অনেক কষ্ট-ক্লেশ ও চেষ্টা-সাধনা করতে হয়েছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। কণ্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল সুদীর্ঘ পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। শিকার হতে হয়েছে অপমান-লাঞ্ছনা, অপদস্ত ও সামাজিক বয়কটের। অতি আপনজন ও মাতৃভূমি ছেড়ে অচেনা দেশে পাড়ি দিতে হয়েছে। রাতের ঘুম হারাম করে, শরীরের ঘাম ও রক্ত ঝরিয়ে ইসলাম নামক এ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উপরন্তু তিনি চাইলে- অনায়াশে আরাম-আয়েশের রাজকীয় এক জীবন উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নেন দুঃখ-কষ্ট, আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রামের জীবন। শত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার পরও তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে মুহূর্তের জন্যেও কিঞ্চিৎ বিচলিত ও কুণ্ঠিত হননি। তাবৎ শিরক-কুফুর ও তাগুতের সামনে মাথা নত করেননি। কারো হুমকি-ধমকি ও রক্তচক্ষুকে পরওয়া করেননি। উম্মাহচিন্তায় সর্বদা তিনি বিষণœ ও বিভোর থাকতেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্দিনে তিনিও চিন্তিত ও অস্থির হয়ে পড়তেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী,) তারা ইমান আনে না, এই মর্মব্যথায় নিজেকে শেষ করে দিবেন।’ (সুরা শুআরা : ০৩)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্যিধ্যে ধন্য সাহাবায়ে কেরামও তারই আদর্শ ও আদলে গড়ে ওঠেন। তার ইন্তেকালের পর তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। তার মিশন বাস্তবায়নে নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দেন। পরবর্তীতে তাবেইন, তাবে-তাবেইন, আইম্মায়ে মুজাতাহিদিন, সালফে সালেহিন ও হক্কানী ওলামায়ে কেরামও উক্ত মিশন বাস্তবায়নে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন। যুগ ও কালের পরিক্রমায় মুসলিমজাতির মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাদের মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনার অনেক রদবদল ঘটেছে। ঘুন ধরেছে তাদের আকীদা ও বিশ^াসে। অলসতা, কর্মহীনতা, বিলাসিতা ও আরামপ্রিয়তা তাদের ওপর জেঁকে বসেছে। বিকারগ্রস্ত হয়েছে তাদের বিবেক ও বিবেচনাবোধ।

সর্বক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা তাদের মন-মগজ, জীবন ও চরিত্রের সাথে মিশে গেছে। পবিত্র কোরআন-সুন্নাহ থেকে তারা অনেক দূরে সরে গেছে। স্বজাতির সাথে শতধা বিভক্তে জড়িয়ে পড়েছে। আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে অমুসলিমদেরকে পরম বন্ধু ও হিতাকাক্সক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে তারা পরিণত হয়েছে পরনির্ভরশীল, খেলাফতশূন্য ও নিতৃত্বহীন অবহেলিত এক জাতিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধরূপে গ্রহণ করো না, তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোনো ত্রুটি করে না; তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশি জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেওয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও।’ (আল ইমরান : ১১৮)।

জাতির এই ক্রান্তিকালে মুসলমানদের স্বমহিমায় ফিরে আসতে হবে। অধঃপতনের এই গহ্বর থেকে উত্তরণে তাদেরকে নবোদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। পবিত্র কোরআন-সুন্নাহকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের মিশনকে বাস্তবায়ন করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও নৈতিকতা উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে। দীনের জন্য পার্থিব সুখ-শান্তি ও আরাম-আয়েশকে পরিহার করে দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ ও সাধনার জীবন বেছে নিতে হবে। তাগুত ও পরাশক্তির সামনে আত্মসম্মানবোধের পরিচয় দিতে হবে। জাতীয় ঐক্য সাধনে স্বজাতির মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

পারস্পরিক ¯েœহ-ভালোবাসা, সম্মান-শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের ‘ভীত’ গড়ে তুলতে হবে। উম্মাহর জিম্মাদারি নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। ন্যায় ও ইনসাফের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। জিহাদী চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ব্যক্তি জীবন থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে চাতুর্যের পরিচয় দিতে হবে এবং শত্রুর মোকাবেলায় চতুর্মুখী শক্তি সঞ্চয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্পদ, জীবন ও কথার মাধ্যমে জিহাদ করো।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২৫০৪)। অন্যের অধিনতা-গোলামী ও পরাধীনতা মুসলিম জাতির সাথে মানায় না। আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে জান্নাতপ্রাপ্তিই হলো মুসলিম জীবনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ও চূড়ান্ত সফলতা।